ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

ইবনে বাইতার: প্রকৃতি প্রেমী এক মুসলিম বিজ্ঞানী

ইমরান উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪২, ৫ নভেম্বর ২০২৩  
ইবনে বাইতার: প্রকৃতি প্রেমী এক মুসলিম বিজ্ঞানী

ইসলামের সোনালী ইতিহাসে মুসলিম মনীষীরা বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে তাদের পদচারণা হয়নি। ইতিহাস, চিকিৎসা, রসায়ন, পদার্থ, গণিত, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে মুসলিম মনীষীরা অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু আমরা আমাদের সম্পদগুলোকে কালের গর্ভে হারিয়ে বসেছি।

তারা অনেকটা আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেছেন। তাদের অবদানকে আমরা স্মরণ করছি না, ভুলতে বসেছি। আমাদের মনীষীদের অবদানগুলো অন্যরা নাম বিকৃত করে বিশ্বে সমাদৃত হচ্ছে। যেসব মুসলিম মনীষীগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাদের একজন হলেন ইবনে বাইতার।

ইবনে বাইতার আমাদের মাঝে বলতে গেলে একেবারে অপরিচিত এক নাম। ইবনে বাইতারের পুরো নাম হচ্ছে আবু মুহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ মালেকি। তার গ্রামের নাম মালেকা। এটা আন্দালুসিয়ার অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রাম। জন্মস্থানের দিক দিয়ে তাকে মালেকি হিসাবে ডাকা হয়।

তৎকালীন সময়ে মনীষীদের অনেকে বিখ্যাত শহর, জন্মস্থানকে নামের সঙ্গে সংযুক্ত করতেন। ইবনে বাইতারও জন্মস্থানকে নামের সঙ্গে যুক্ত করেন। তবে তিনি মালেকি মাজহাবের অনুসারি ছিলেন না। তার পিতা ছিলেন দক্ষ পশু চিকিৎসক। পশু চিকিৎসককে আরবিতে বলা হয় বাইতার। এই বাইতার থেকে তার উপনাম হয় ইবনে বাইতার।

ছোট থেকেই ইবনে বাইতার ছিলেন প্রকৃতি প্রেমী। এই প্রকৃতির প্রেমে তিনি বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। আস্তে আস্তে প্রকৃতির সঙ্গে তার মিতালি ভালোই জমে যায়। সারাদিন ঘুরে ঘুরে তিনি প্রকৃতি দেখতেন।  এই প্রকৃতি প্রেম থেকে তিনি আস্তে আস্তে হয়ে ওঠেন প্রকৃতি গবেষক।

প্রকৃতি প্রেমের কারণে বনজঙ্গলই হয়ে উঠে তার বিদ্যালয়। তবে এমন নয় য়ে, তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা করেননি। তিনি সেভিলের পণ্ডিত আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ফায়াজের কাছে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের পাঠ শুরু করেন। ইবনে ফায়াজ নাবাতি ছিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের উপর ভালো পণ্ডিত। ইবনে বাইতার দ্রুত সময়ের মধ্যে তার ওস্তাদকে ছাড়িয়ে যান। তিনি তৎকালীন সময়ে উদ্ভিদ গবেষণায় সবাইকে ছাড়িয়ে যান।

তৎকালিন মুসলিম মনীষাগণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতেন। ইবনে বাইতার তার ব্যতিক্রম নয়। ইবনে বাইতারের মধ্যে জ্ঞানের প্রতি প্রবল আগ্রহ  ছিল। বয়স যখন ২০ বছর, তখন তিনি বিভিন্ন দেশ সফরে বেরিয়ে যান। গ্রিস, রোম, মরক্কো, মারাকেশ, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, এশিয়া মাইনর, আনতাকিয়া, সিরিয়া, হিজায, গাজা, জেরুসালেম, বৈরুত, মিশরসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। এসব দেশে গিয়ে জ্ঞানী-গুণীদের সাহচর্য লাভ করেন। তাদের সঙ্গে উদ্ভিদের প্রকার, বৈশিষ্ট্য উপকারিতা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন।

তিনি বন-জঙ্গলে গিয়ে ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করতেন। এমনকি উদ্ভিদ উৎপাদনস্থলও তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন গভীরভাবে। সম্পর্কে ইবনে আবি উসাইরিয়া বলেন, 'দামেশকের বাইরে তার সঙ্গে বনে-জঙ্গলে প্রচুর গাছপালা দেখেছি।’

সুলতান আল-কামিলের শাসনকালে তিনি মিশরে অবস্থান শুরু করেন। সুলতান তাকে নিযুক্ত করেন প্রধান ভেষজ বিজ্ঞানী হিসাবে। তিনি ছিলেন উদ্ভিদ ভেষজ ওষুধের ক্ষেত্রে সুলতানের আস্থাভাজন। সুলতান আল-কামিলের ইন্তেকালের পর তিনি সুলতান নাজমুদ্দিন আইয়ুবের অধীনে কাজ শুরু করেন। তার দরবারেও তিনি বেশ সমাদৃত ছিলেন।

তার ভ্রমণ সঙ্গী ইবনে আবি উসাইবিয়া বলেন, 'আমি তার কাছে ডায়োসকোরাইডসের মেটেরিয়া মেডিকা গ্রন্থের ব্যাখ্যা পড়েছি। তার বিস্তৃত জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা অনুধাবন শক্তি আমাকে মুগ্ধ সমৃদ্ধ করেছে। গ্যালেন, গাফিকি ডায়োসকোরাইডসসহ এই শাস্ত্রের দিকপালদের গুরুত্বপূর্ণ বই নিয়ে আমি তার কাছে উপস্থিত হতাম।'

ইবনে বাইতার তার পূর্বের এবং সমকালীন যারা গবেষক চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন সবাইকে তিনি ভালোভাবে অধ্যয়ন করেছেন। মুসলিম গবেষকগণ বিষয়ে যেসব রচনা রেখে গেছে, সেসবও তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। ইবনে সিনা, আল-ইদরিসি, ইবনুল আব্বাস নাবাতি প্রমুখের গ্রন্থাদি তিনি পাঠ করেন এবং নিগূঢ় মর্ম ব্যাখ্যা করেন। আবার তিনি অধ্যয়নে থেমে যাননি, এ গ্রন্থগুলোর শুদ্ধি  অভিযান চালিয়ে সংশোধন-সংযোজন সমালোচনা করেছেন বলেও জানা যায়।

রম ল্যান্ডো তার লেখা ইসহামু উলামাইল আরব ফিল হাযারাতিল উরুব্বিয়া গ্রন্থে বলেন, উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ইবনে রাইতারের অবদান ডায়োসকোরাইডসসহ পূর্ববর্তীদের সব অবদান ছাড়িয়ে গেছে। তার একচ্ছত্র প্রভাব দশম হিজরি শতাব্দী পর্যন্ত বলবৎ ছিল।

তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- আল জামি লি মুফরাদাতিল আদভিয়া ওয়াল আগযিয়া' (ঔষধপত্রের শব্দকোষ) ইবনে বাইতার এই বইয়ে কোন উদ্ভিদ থেকে কোন ঔষধ তৈরি হয় সেগুলো বর্ণনা করেছেন। প্রতিটি উদ্ভিদের আলাদা আলাদা গুণ, ঔষধের উপকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ তিনি সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ বণর্না করেছেন।

তার বইয়ের আরেকটা বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি বইয়ে উদ্ভিদের ঔষধের নাম লিখতেন। তারপর সেগুলোর বর্ণনাও করে দিতেন। ফলে শিল্প বিল্পবের আগ পর্যন্ত এই বইই ছিল ইউরোপের চিকিৎসা বিজ্ঞানের একমাত্র ভরসাস্থল। তিনি বইয়ে প্রায় ১৪০০ ঔষধের নাম লিখেন বলে জানা যায়। যার মধ্যে ৩০০টি তার নিজে আবিস্কার। ইবনে বাইতারের আরেকটি গ্রন্থ আল মুগনি ফিল আদভিয়াতিল মুফরাদা আছে; যেখানে তিনি বিভিন্ন অঙ্গের চিকিৎসা ঔষধের কথা উল্লেখ করেন।

ইবনে বাইতারের বিষয়ে ইউরোপীয়রা তৎকালীন আরব বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখক এবং ভেষজ উদ্ভিদ বিশারদ হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছে। তিনি ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে উদ্ভিদের নানান রকমের ঔষধ উৎপাদনে এক বিরল সাক্ষর রাখা এ মনীষী ১২৪৮ খ্রিস্টাব্দে দামেস্ক শহরে ইন্তেকাল করেন।

মুসলিম মনীষাগণ ইতিহাসে আমাদের জন্য অনেক গৌরবময় অধ্যায় রেখে গেছেন। তাদের অবদান স্মরণ করা একান্ত কাম্য।

-লেখক: শিক্ষার্থী, আরবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়