ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

ইসলাম নামাজ-রোজায় সীমাবদ্ধ নয়

হাবিবুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১২, ২০ নভেম্বর ২০২৩  
ইসলাম নামাজ-রোজায় সীমাবদ্ধ নয়

ইসলাম হলো কুরআন ও হাদিস দ্বারা পরিচালিত একেশ্বরবাদী ধর্ম ও জীবনপদ্ধতি। কিন্তু বর্তমানে ইসলামকে আমরা শুধু ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। আমরা মনে করি যে, ইসলাম হলো শুধু স্রষ্টাভিত্তিক কাজকর্ম। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, হজ করা ও যাকাত দেওয়া। ইসলামকে আমরা শুধু এসব গণ্ডির মধ্যেই রাখতে ভালোবাসি। কিন্তু ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ এক জীবনব্যবস্থা সেটা মানতে চাই না।

আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাজনীতি, অর্থ, রাষ্ট্র প্রতিটা ক্ষেত্রেই আল্লাহর কোরআন ও নবী মুহাম্মদ (স:) এর হাদিস অনুসারে সার্বিক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাকে ইসলাম বলে। শুধু নামাজ রোজায় ইসলাম সীমাবদ্ধ না। ইসলামের পরিধি ব্যাপক, বিস্তৃতি। ইসলামের প্রসারণ আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু, দোলনা থেকে কবর, পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত।

আমাদের ইহকালীন-পরকালীন মুক্তি, শান্তির জন্য ইসলামই একমাত্র জীবনব্যবস্থা এবং পথপ্রদর্শক। ইসলাম একটা সুশৃঙ্খল, পরিপাটি, সাজানো-গোছানো জীবনপদ্ধতি। ইসলামকে শুধু ধর্ম বলে একে আমি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করতে চাই না। ইসলাম হলো পূর্ণাঙ্গ, স্বাধীন এক জীবনব্যবস্থা, যা ব্যক্তির জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে।

ইসলামের সৌন্দর্যের কথা বললে বলে শেষ করা যাবে না। ইসলামের যে মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভ আছে, যার উপর ভিত্তি করে ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে। যেমন- ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত। এ পাঁচটি স্তম্ভের দিকে তাকালেই আমরা ইসলামের সৌন্দর্যতা খুঁজে পাবো। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জন্য এ পাঁচটি স্তম্ভ ফরজ বা অত্যাবশ্যক করেছেন।

প্রথমে আমরা নামাজের কথায় আসি। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জন্য প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। পাড়া-মহল্লার সবাই এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে একে অন্যকে দেখার, খোঁজ খবর নেওয়ার সুযোগ হয়। একত্রে সারিবদ্ধভাবে যখন জামায়াতে দাঁড়ায় তখন সমাজের উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য বা ভেদাভেদ থাকে না। তখনই সবাই এক আল্লাহর স্মরণে, এক আল্লাহর কাছে মাথা নত করে।

আল্লাহ তাআলা নামাজের পাশাপাশি যাকাতকেও ফরজ করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সুরা বাকারার ২৭৭ আয়াতে বলেন, ‘যাঁরা আল্লাহর উপর ঈমান এনে সৎ কাজ করবে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত আদায় করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং চিন্তিতও হবে না।’ কোরআন আল্লাহ সুবহানাওয়া তাআলা ৮২ বার নামাজের সাথে সাথে যাকাতের কথা বলেছেন। সুতরাং নামাজ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি যাকাজ আদাইও সমান গুরুত্বপূর্ণ।  যাকাত হলো ধনীর সম্পদ থেকে গরিবের জন্য প্রাপ্ত অধিকার। আল্লাহ পৃথিবীতে সবাইকে সমান সম্পদ দিয়ে পাঠাননি। কাউকে ধনী, কাউকে গরিব করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তবে এতে ধনী গরিব উভয়ের জন্যই দৃষ্টান্ত রয়েছে। ধনীর সম্পদ থেকে গরিবরা পাবে। এ যাকাত প্রদানের ফলে ধনী গরিবের মধ্যে বৈষম্য, পার্থক্য দূর হয়। আল্লাহ তাআলা কী সুন্দর করেই না বৈষম্য নিরসনের উপায় বলে দিয়েছেন!

ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ হলো রোজা। রমজান মাসে সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকা হলো রোজা। আল্লাহ তার বান্দাদের উদ্দেশ্য করে কোরআনে সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটা করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’

এ মাস হলো আল্লাহর বিধিনিষেধ, হুকুম আহকাম মান্য করার মাস। আল্লাহ তাআলা এখানে দেখিয়েছেন যে, যারা অনাহার অর্ধাহারে কতটা কষ্টে দিন কাটায় তা ধনীরা বুঝবে না। তাই তিনি রোজার মাধ্যমে গরিবের দুঃখ, কষ্টটা তুলে ধরেছেন। পুরো এক মাস ধনীরা অনাহারে রোজা রেখে ক্ষুধার্তের অবস্থা বুঝতে পারে।  আল্লাহ কত সুন্দর করেই না রোজার ফজিলত তুলে ধরেছেন তাঁর বান্দার কাছে।

এবার আসি ইসলামের সর্বশেষ স্তম্ভ হজ্জের কথায়। আল্লাহ প্রত্যেক সুস্থ, সবল, বিবেকবান, সামর্থবান প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য হজ্জ ফরজ করেছেন। হজ্জ হলো মুসলমানদের জন্য মিলনমেলা, যাকে বলা হয় মহাসম্মেলন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসলমান পবিত্র মক্কা মদিনায় জিলহজ্জ মাসে কিছু দিনের জন্য একত্রিত হন। তাদের ভাষা, আচার-আচরণ, চলাচল, পোষাক, আকার-আকৃতি সর্বব্যাপী প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সংস্কৃতি হওয়া সত্ত্বেও সবাই এক মনে, একই সাদা পোষাকে মহান আল্লাহর ডাকে একত্রিত হন। সবার মুখে এক আল্লাহর নাম।

আল্লাহ তাআলা হজ্জকে ফরজ করে গোটা মুসলিম জাতিকে একত্র করার সুযোগ করে দিলেন। তাদের একে অন্যের ভাষা, আচরণ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক রীতিনীতি বুঝতে, একে অন্যের সংস্কৃতি জানতে কী অপরূপ এক মিলনমেলা! এই হজ্জের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিমদের মাঝে এক ভ্রাতৃত্বের তৈরি হয়।

ইসলাম শুধু পাঁচটি স্তম্ভেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পরিসর আরও ব্যাপক, বিস্তৃত। আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা, সব ক্ষেত্রেই ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবারের সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, গরিব-এতিমের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা, সমাজের একে অন্যের খোঁজ খবর নেওয়াসহ সব ক্ষেত্রেই ইসলামের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ব্যক্তির আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ, কথার মাধুর্যতা সবখানেই ইসলামের গুরুত্ব, প্রভাব করেছে।

ইসলাম মানুষকে মুক্তির আহবান করে, আত্মার পরিশুদ্ধি করে। ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বিশ্বাস, ভালোবাসা তৈরি করে। প্রতিবেশীর হক আদায়, তাদের খোঁজ খবর নেওয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করা, রোগ শোকে পাশে থাকা ইত্যাদি কাজের নির্দেশনা দেয়  ইসলাম। পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ করলে মানুষের ইহকালে ও পরকালে মুক্তি মিলবে।
ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত রাষ্ট্রনায়ক ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয়, উঁচু-নিচুর মধ্যে কখনো পার্থক্য করবে না। তার মনে স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান থাকবে না। ব্যক্তির স্ব-স্ব যোগ্যতা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কাজের দায়িত্ব পাবে, সে দলীয় বা বিরুদ্ধ দলীয় লোক হলেও। ইসলামই নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী করেছে। নারীর অধিকার রক্ষায় পুরুষ সবসময়ই সোচ্চার থাকবে।

মোটকথা, ইসলাম মানুষের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করে। ইসলামি আর্দশে জীবন পরিচালনা করলে ইহকালে যেমন শান্তিতে বসবাস করতে পারে, তেমনি পরকালে কল্যাণের পথও সুগম হয়। আমরা ইসলামকে শুধু ধর্ম মনে না করে বা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে, এর পাঁচটি স্তম্ভের বাইরেও চিন্তার প্রসার ঘটাই। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য পেতে হলে আমাদের পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করতে হবে।

নিজের মন মতো ইসলাম মানলে, নিজের ইচ্ছে মতো চললে, ইসলামের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে সুরা বাকারার ২০৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’

সুতরাং আমাদের আল্লাহর কথা মেনে পরিপূর্ণ মুমিন হয়ে ইসলামে প্রবেশ করতে হবে। আমরা যা করি তা-ই আমাদের কর্মফল। আমরা পুনরুত্থানের দিনে আমাদের কর্ম অনুযায়ী ফল পাবো। ভালো কাজের জন্য জান্নাত, খারাপ কাজের জন্য জাহান্নাম। তাই আমাদের এই সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। ভালো কাজে আদেশ, মন্দ কাজে নিষেধ করে ইসলামি সৌন্দর্যের আলোকে নিজে, পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে।

-লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়