ঢাকা     সোমবার   ০১ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৭ ১৪৩১

মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতিও নজর দেওয়া জরুরি

সাহীদ বিন আহমদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৩, ২৪ নভেম্বর ২০২৩  
মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতিও নজর দেওয়া জরুরি

মাদ্রাসা শিক্ষা সাধারণত ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়। যেখানে ছাত্ররা কুরআন, ইসলামি আইন, ধর্মতত্ত্ব এবং আরবি ভাষার উপর দক্ষতা অর্জন করে। ইসলামি স্বর্ণযুগে মাদ্রাসায় সমৃদ্ধ পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিলো। পাঠ্যক্রমে কেবল ধর্মীয় অধ্যয়নই নয়, বরং বিজ্ঞান, গণিত এবং দর্শনের মতো বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকতো।

উদাহরণ হিসেবে অষ্টম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর বাগদাদের ‘বায়ত আল-হিকমাহ’র কথা বলা যেতে পারে। বায়ত আল-হিকমাহ ছিলো একটি প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র, যেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মতাবলম্বীর পণ্ডিতরা গ্রীক, রোমান, ফার্সি, ভারতীয় এবং অন্যান্য সভ্যতার শাস্ত্রীয় রচনাগুলো অনুবাদ, সংরক্ষণ এবং অধ্যয়নের জন্য একত্রিত হয়েছিলেন। যদিও এটি ঐতিহ্যগত অর্থে আজকের মাদ্রাসার মতো মাদ্রাসা ছিল না। এটি বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং শৃঙ্খলা জুড়ে জ্ঞানের সংমিশ্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ওই সময়ে ইসলামিক পণ্ডিতরা জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসা এবং দর্শনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আল-রাজি, ইবনে-সিনা, আল-কিন্দি এবং আল-ফারাবির মতো ব্যক্তিত্বরা চিকিৎসা, গণিত এবং দর্শনে তাদের অবদানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এই পণ্ডিতরা প্রায়ই ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ অধ্যয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।

বায়ত আল-হিকমাহ ছাড়াও ইসলামি বিশ্বে শিক্ষার অন্যান্য কেন্দ্র ছিল, যেখানে বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হত। স্পেনের কর্ডোভা (আল-আন্দালুস) একটি সমৃদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিলো, যেখানে ইসলাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয়ই অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলা যাক। বাংলাদেশে বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষার প্রধানত দুইটা পর্যায় দেখতে পারি। প্রথমত, আলিয়া মাদ্রাসা; যারা ইসলামিক এবং জেনারেল কারিক্যুলাম অনুসরণ করে। দ্বিতীয়ত, কওমী মাদ্রাসা; যারা শুধু ইসলামি কারিক্যুলাম অনুসরণ করে। একজন আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র হয়ে আলিয়া মাদ্রাসায় বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করাই আমার উদ্দেশ্য।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, মাদ্রাসা শিক্ষা শুধুই যে ইসলামিক ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রিক ছিলো বিষয়টা এমন না। বর্তমানে আলিয়া মাদ্রাসায় দুই ধরণের ছাত্ররা ভর্তি হয়ে থাকে। প্রথমত, যারা তুলনামূলক আধুনিক জ্ঞানের পাশাপাশি ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান (আলেম) সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান আহরণ করতে চান। দ্বিতীয়ত যারা বিস্তর আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি তুলনামূলক ইসলামি জ্ঞান আহরণ করতে চান।

বর্তমানে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে, ইসলামি স্বর্ণযুগের মাদ্রাসার শিক্ষার কার্যক্রমের সঙ্গে বিস্তর ফারাক যে আছে, তা কিন্তু নয়। তবে যেটা ভাবার বিষয়, এত সমৃদ্ধ শিক্ষাক্রম থাকার পরও কেনো দেশের উচ্চশিক্ষার স্তর তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাদ্রাসা থেকে আমরা বেশি সংখ্যক ছাত্র দেখতে পারছি না?

এর বিভিন্ন কারণ লক্ষণীয়। তন্মধ্যে, যোগ্য শিক্ষক সংকট অন্যতম সমস্যা। আমরা বিগত কিছু বছর যাবৎ দেখতে পারছি, মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে পরিবর্তন আনা হলেও যে বইগুলো ছাত্রদের হাতে দেওয়া হয়, এগুলো সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ও দক্ষতা মাদ্রাসার শিক্ষকদের কতটা আছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। অধিকাংশ আলিয়া মাদ্রাসায় না আছে আরবি শিক্ষাক্রমের জন্য যোগ্য শিক্ষক, না জেনারেল শিক্ষার জন্য যোগ্য শিক্ষক।

এদিকে যোগ্য শিক্ষক না আসার বিভিন্ন কারণও থাকতে পারে, যা ভাবার এবং সমাধানের সময় এসেছে। আবার স্কুল, কলেজের ছাত্রদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রমে রয়েছে বিস্তর ফারাক। যদিও পূর্বের তুলনায় এই হারটা কমেছে। তার কারণ হলো মাদ্রাসা ছাত্রদের আরবি কেন্দ্রিক অনেকগুলো বিষয় পড়তে হয়। আবার যোগ্য শিক্ষকের অপ্রতুলতার কারণে আমরা মেধাবী ছাত্রগুলো আলিম তথা উচ্চ মাধ্যমিকের পর ধরে রাখতে পারছি না। অনেকে কওমী মাদ্রাসায় চলে যাচ্ছে আরবি কেন্দ্রিক উচ্চ শিক্ষার জন্য, আবার কিছু যাচ্ছে জেনারেলে। যা আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য সুখকর কোনো বিষয় না। আবার এমনও ছাত্র আছে যারা ভাবে যে, আলিম পর্যন্ত মাদ্রাসায় পড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়বে। তারাও হচ্ছে ভোগান্তির স্বীকার।

আমরা অবগত আছি, বর্তমান সময়টাই প্রতিযোগিতার। একজন মাদ্রাসা থেকে আসা ছাত্র হয়ে বুঝতে পারি যে, মাদ্রাসার ছাত্ররা স্কুল, কলেজের ছাত্রদের থেকে কম মেধাবী বা পিছিয়ে পড়া, এটা অবিশ্বাসযোগ্য। মাদ্রাসার ছাত্ররা সবচেয়ে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে যোগ্য শিক্ষকের অপ্রতুলতায়। ফলে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ভীতি কাজ করছে। আবার অনেক পর্যায়ে দেখা যায় এই বিষয়গুলো পাঠদানের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অবহেলা দেখায়। যে কারণে নবম শ্রেণিতে উঠৈই অনেক মেধাবী ছাত্র জেনারেলে চলে যায়।

মাদ্রাসার ছাত্রদের যারা আলিম পরীক্ষা দিয়ে ভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হতে চায়, দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগই কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না। কারণ তাদের প্রধান দুর্বলতা ইংরেজিতে। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রছাত্রীদের যারা মানবিক শাখার, তারা তেমন যোগ্য শিক্ষক পাচ্ছে না। যেমনটা কলেজের ছাত্ররা পাচ্ছে।

যোগ্য শিক্ষক মাদ্রাসায় যদি নিয়োগ দেওয়াও হয়, সেখানে ওই শিক্ষকের বেতন-ভাতা তুলনামূলক বেশী দেওয়া লাগে কর্তৃপক্ষের। যা বেশিরভাগ মাদ্রাসার পক্ষে অসম্ভব। ইংরেজির মতো গণিত, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা। দেখা যায়, বিজ্ঞান, গণিত বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে যে ছাত্ররা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়, তারাও কলেজের ছাত্রদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে। কিছু ব্যতিক্রম তো থাকেই, যারা কলেজের বিভিন্ন শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ে উন্নতি করছে।

একটা আশার কথা হলো দেশে বিভিন্ন ক্যাডেট মাদ্রাসায় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। একই সঙ্গে হতাশার কথা হলো, সেখানে ধনী পরিবারের সন্তানরাই পড়তে পারছে। এমনও মাদ্রাসা আছে বাংলাদেশে, যেখানে বিজ্ঞান বিভাগ আছে। তবে পড়াশোনা কোন্ পর্যায়ের হয় তা প্রশ্নবিদ্ধ।

মাদ্রাসা শিক্ষার কারিকুলামে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে যে শিক্ষকরা এগুলো পড়াবেন, তারা কতটা প্রস্তুত আছে এটাও একটা প্রশ্ন। শুধু কারিকুলামে পরিবর্তন আনলেই মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক পর্যায়ে উন্নিত করা যাবে না, এটা চিরন্তন সত্য। তাতে দিন দিন মাদ্রাসা শিক্ষা ধ্বংসের দিকে যাবে।

এখন একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। নতুন কারিকুলাম শিক্ষকদের হাতে দেওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যেমন- শিক্ষকদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের বেতনভাতা বৃদ্ধি এবং যারা আলেম হতে চায় তাদের আলিম পরীক্ষার পর মাদ্রাসায় রেখেই যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মাদরাসা বোর্ড এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহলের ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। নতুবা মাদ্রাসা শিক্ষা কতটা উন্নত হবে বা কবে হবে কিংবা আদৌ হবে কিনা, তা বলা যাচ্ছে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়