ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

রাবিতে চিকিৎসা কেন্দ্র আছে, সেবা নেই

শাকিবুল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০২, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩  
রাবিতে চিকিৎসা কেন্দ্র আছে, সেবা নেই

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বর্তমানে ৩০ হাজারের অধিক নিয়মিত শিক্ষার্থী। তাদের চিকিৎসার জন্য  বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পদ রয়েছে ৩৬টি। কিন্তু সেই পদের বিপরীতে বর্তমানে ডাক্তার আছেন মাত্র ১৫ জন। কাগজে কলমে ১৮ জন ডাক্তার থাকলেও দুইজন খণ্ডকালীন ও সম্প্রতি একজন সাময়িক বহিস্কার হয়েছেন। এভাবেই অর্ধেকেরও কম চিকিৎসক দিয়েই চলছে রাবির মেডিকেল সেন্টারের কার্যক্রম।

পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় একদিকে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দিতে বিড়ম্বনায় পড়ছেন কর্মরত চিকিৎসগণ। অন্যদিকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। চিকিৎসক সংকট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন খোদ প্রধান চিকিৎসক। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ থাকায় চাইলেও কোনো চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল সেন্টার সূত্রে জানা যায়, ১৭টি শূন্য পদের বিপরীতে ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর সর্বশেষ চিকিৎসক পদে ১৩ জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তবে তাদের মৌখিক পরীক্ষা না হওয়ায় নিয়োগ কার্যক্রম আটকে আছে। বর্তমানে মেডিকেল সেন্টারে ১৮ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এর মধ্যে দুইজন খণ্ডকালীন ও একজন সাময়িক বহিস্কৃত। ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ছয়জনের বিপরীতে রয়েছেন তিনজন।

এছাড়াও মেডিসিন, নাক-কান-গলা, চর্ম, মনরোগ ও গাইনোকোলোজিস্টের কোনো চিকিৎসক নেই। নেই কোনো মাইক্রো বাইয়োলোজিস্ট, পেশেন্ট বেড ও পর্যাপ্ত অক্সিজেন চ্যানেল। এখানে ইসিজি মেশিন আছে, তবে সেটা পরিচালনা করার জন্য একজনও স্পেসালিস্ট নাই। ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন থাকলেও সেটা পরিচালনার জন্য পূর্ণকালীন টেকনোলোজিস্ট নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০ হাজারে অধিক আছে নারী শিক্ষার্থী। তবে তাদের জন্য মেডিকেল সেন্টারে কোনো গাইনোকোলোজিস্ট নেই। ফলে নারী শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফার্মেসিতে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কাউন্টার থাকলেও জনবল সংকটের কারণে এক কাউন্টার থেকে ওষুধ নিতে গিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় শিক্ষার্থীদের।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাবাহ কানিতা তারিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার থেকে আমরা সব ধরনের সেবা পাওয়ার আশা রাখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশের শিক্ষার্থী থাকে নারী। কিন্তু আমাদের রাবি মেডিকেল সেন্টারে গাইনোকোলোজিস্ট না থাকায় আমরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের এ পদটি রয়েছে। নারী শিক্ষার্থীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পাশাপাশি তাদের প্রতি অবহেলারও বহিঃপ্রকাশ পাচ্ছে।

নারী চিকিৎসক সংকটের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক্স ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী তাসমীম তাসফিয়া হক আরশি বলেন, প্রত্যেকটি মেয়ের পিরিয়ড চলাকালীন সময়সহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে হয়। এসব রোগের চিকিৎসার জন্য একজন গাইনি চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে কোনো গাইনি চিকিৎসক নেই। ফলে আমরা ফি দিয়েও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আর যাদের সামর্থ নেই, তারা বাইরেও চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে না।

মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী মিথুন রায় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধার দাবিদার। কিন্তু আমরা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ি আমাদের মেডিকেল সেন্টার থাকার পরও আমরা সঠিক চিকিৎসা পাই না। জ্বর-সর্দি নিয়ে প্রথমে একটা ছাত্র মেডিকেল সেন্টারে যায়, তার কি হয়েছে তা জানার জন্য। তারপর দেখা যায় একজন ডাক্তারের কাছে গেলে সে কিছু না দেখেই নাপা ধরিয়ে দেয়। একটু ব্যাথা থাকলে ইনজেকশন দিয়ে দেয়। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা ব্যাবস্থা এভাবে চলতে পারে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক মোবাররা সিদ্দিকা বলেন, ‘নারীদের নানা গোপনীয় সমস্যা থাকে। যেগুলো তারা পুরুষ চিকিৎসকের কাছে খুলে বলতে পারেন না। কিন্তু আমাদের মেডিকেল সেন্টারে কোনো গাইনি চিকিৎসক নেই। আমাদের ছাত্রীদের জন্য গাইনী ডাক্তার এবং অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রেও আলাদাভাবে মহিলা ডাক্তার প্রয়োজন। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিৎ মেডিকেল সেন্টারে নারী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিকেল সেন্টারের একজন ডাক্তার বলেন, প্রতিদিন এককেজন চিকিৎসককে গড়ে ৮০ জনের বেশি রোগী দেখা লাগে। যেটা অনেক বেশি কষ্টের। রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। প্রতিদিন অধিক সংখ্যক রোগী দেখতে গিয়ে কনসেন্ট্রেশন ধরে রাখা খুবই কঠিন হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের ভলো সার্ভিস দেওয়ার জন্য চিকিৎসক বাড়ানো হলে আমাদের এবং শিক্ষার্থীদের ভোগন্তিটা কমে আসবে।

এ বিষয়ে মেডিকেল সেন্টারের প্রধান চিকিৎসক ডা. তবিবুর রহমান শেখ বলেন, ‘আমাদের এখানে চিকিৎসকের খুব বেশিই স্বল্পতা আছে। চিকিৎসক সংকটের কারণে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শুধু চিকিৎসক সংকটই নয়, অভাব রয়েছে যন্ত্র পরিচালনার জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান ও পরিক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্যাথলজিস্টের। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই সমস্যার সমাধানের জন্য চেষ্টা করলে খুব সুন্দরভাবে শিক্ষার্থীদের সেবা দিতে পারবো।’

শিক্ষার্থীদের সঠিক চিকিৎসা না পাওয়া ও ‘নাপা সেন্টারের’ অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা মেডিকেল সেন্টার। সাধারণত প্রাথমিক ও ছোটখাটো চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় এখানে। অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, যেকোনো চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেলে রেফার করা হয়। এটা করা হয়ে থাকে মূলত ভালো চিকিৎসার জন্য। আমাদের ইনডোর চালু রাখার মতো কোনো ইন্সট্রুমেন্ট নেই। পেশেন্ট বেড নেই, পর্যাপ্ত অক্সিজেন চ্যানেল নেই। তাই আমরা তাদের ভালো চিকিৎসার জন্য রামেকে রেফার করি। তবে এখানে যেসব রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে, তার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের মেডিকেল সেন্টারে ৪১ প্রকারের ওষুধ সাপ্লাই আছে। রোগ অনুযায়ী আমরা পেসক্রিপশন করে থাকি। অধিকাংশ শিক্ষার্থী জ্বর, মাথা ব্যথা নিয়ে প্রাথমিকভাবে এখানে আসে। যারা জ্বর, সর্দি নিয়ে মেডিকেলে আসে তাদেরকে সাধারণত নাপা বা নাপা জাতীয় ওষুধ দিয়ে থাকি।

মেডিকেল সেন্টারে নারী চিকিৎসক স্বল্পতার বিষয়ে জানতে চাইলে এ প্রধান চিকিৎসক বলেন, আমাদের নারী চিকিৎসকের সংকট থাকলেও চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের জন্য কোনো গাইনি চিকিৎসক নেই। নিয়োগ নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব পদ শূন্য আছে। নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে।

সার্বিক বিষয়ে রাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক ও ছোটখাটো চিকিৎসা দেওয়া হয়। এটা কোনো হাসপাতাল নয়। যেগুলো বড় বড় সমস্যা, সেগুলো রামেকে পাঠানো হয়। আমাদের চিকিৎসক সংখ্যা কম থাকায় ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সরকার কর্তৃক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে । তাই আমরা সরাসরি নিয়োগ দিতে পারছি না। বর্তমানে যে ডাক্তাগুলো আছেন সবাইকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগীতা করার কথা বলা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে একজন ডাক্তারকে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে হবে। সবাই যদি ৮ ঘণ্টা সঠিকভাবে ডিউটি পালন করেন, তাহলে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া কঠিন হবে না। হয়তো একটু কষ্ট হবে।’

ডাক্তার নিয়োগ ও গাইনী ডাক্তার না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনবল সংকট রয়েছে। এখন নিষেধাজ্ঞার করণে নিয়োগ দিতে পারছি না। আর এখানে যে যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে আসা হয়েছে, তার পূর্বেই প্রশিক্ষিত জনবল সেখানে নিয়োগ দিয়ে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিলো। নিয়োগ নিষেধাজ্ঞার কারণে সেগুলো ওই সময় করা হয়নি। আর স্বল্প টাকা দিয়ে খণ্ডকালীন এই কাজগুলো কেউ করতেও আসে না। তাই আমরা বিকল্পভাবে চেষ্টা করছি যে কিভাবে চালু রাখা যায়। তাছাড়া আমাদের মেডিকেল সেন্টারে যেসব মহিলা ডাক্তার আছেন, তাদের মধ্যে থেকে একজনকে গাইনী বিভাগের দায়িত্বে রাখলেও কিছুটা সমাধান হবে। এখন আমরা যদি সবাই সবাইকে সহযোগিতা করি তাহলে এই সমস্যা হয়তো অনেকটাই সমাধান করতে পারবো আমরা।’

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়