ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

সেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে সংগঠকদের ভাবনা

ইদুল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৫, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩  
সেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে সংগঠকদের ভাবনা

সুস্থ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সব সময় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যাচ্ছে সামাজিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। আলোচনা সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা সমস্যার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন সেবা, শিক্ষা এবং বিনোদনমূলক কাজও করে তারা, যা থেকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়।

শিক্ষার্থীদের জীবনে সামাজিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠকদের মতামত ও পরামর্শের কথা জানাচ্ছেন রাইজিংবিডি ইবি সংবাদদাতা ইদুল হাসান।

সময়ের সঠিক ব্যবহার শেখায় সংগঠন

শিক্ষার্থীরা উচ্চ-মাধ্যমিক শেষে এক গুচ্ছ স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্বপ্ন পূরণের এ যাত্রায় সমস্যার সূত্রপাত ঘটে তখন, যখন সে বুঝে উঠতে পারে না লেখাপড়ার পাশাপাশি বাকি সময়ে তার কী করা উচিৎ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ ক্লাস-পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন, ল্যাব ইত্যাদির পর যে সময়টুকু থাকে সেটা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা, ঘুরাঘুরি অথবা রুমে শুয়ে-বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশাল মিডিয়াতে ব্যয় করেন। ভয়ানক ব্যাপার হলো, কিছু শিক্ষার্থী আবার মাদকের মতো ভয়ানক নেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন! ফলে দিন শেষে স্বপ্ন পূরণের খাতায় হিসেব মেলাতে বেশ বেগ পোহাতে হয়।তবে এদের মাঝে আরেকটি শ্রেণি আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হন।

পড়াশোনার পাশাপাশি অর্জন করেন নেতৃত্বের গুণাবলী, যোগাযোগ দক্ষতা, কম্পিউটার ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা, টিম-ওয়ার্ক এবং টাইম ম্যানেজমেন্টসহ আরও নানাবিধ গুণ। এছাড়া একজন সেচ্ছাসেবী হিসেবে সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হতে শেখে। আর এসব দক্ষতা ও গুণগুলো একজন শিক্ষার্থীকে কর্মজীবনের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। ফলে বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে দিনাতিপাত করতে হয় না৷
(লেখক: মুশা হাশেমী, সভাপতি, ইউনিট কাউন্সিল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ।)

সংগঠন করা শিক্ষার্থীরা অন্যদের থেকে আলাদা

সংগঠন একজন শিক্ষার্থীকে সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা ও সুশৃঙ্খল জীবন গঠন ও আমাদের সুপ্ত প্রতিভাগুলো বিকশিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এলোমেলো জীবনযাপনের পরিবর্তে ক্যারিয়ার প্লানিংয়ে অনেক বেশি সতর্ক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। সেই সঙ্গে নিয়মিত বিভিন্ন সেমিনার ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে ছাত্র অবস্থাতেই নেতৃত্বের গুণাবলি, গ্রুপ ভিত্তিক কাজের অভিজ্ঞতা, প্রেজেন্টেশন স্কিলের উন্নয়নসহ দক্ষ গ্রাজুয়েট হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

সংগঠনের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় হতাশা ও অবসাদ থেকেও অনেকাংশে মুক্ত থাকা যায়। একই সঙ্গে যেসব শিক্ষার্থীরা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের থেকে সবদিক দিয়ে এগিয়ে রাখে। তাই আমি মনে করি, যার যে-ধরনের কাজে আগ্রহ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ধরনের অন্তত একটি সংগঠনের সঙ্গে সব শিক্ষার্থীদের যুক্ত হয়ে নিজেকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন।
(লেখক: আবু তালহা আকাশ, সভাপতি, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইবি শাখা।)

মেধা বিকাশে সংগঠনে যুক্ত হওয়া জরুরি

অনেকের মধ্যে মেধার প্রাচুর্যতা থাকলেও ভালো প্ল্যাটফর্ম না থাকায় বিকশিত করতে পারে না। ফলে নিজেকে চেনা বা মূল্যায়ন করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে। নিজেকে বিকশিত না করতে পারলে বা জ্ঞানকে বিকশিত না করতে পারলে, তার দ্বারা দেশ ও জাতির কোনো উপকার হবে কি-না তা একটু সন্দেহের বিষয়। কোনো ব্যক্তি যদি ডাক্তারি পড়াশোনা করে শুধু নিজেকে জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন, তাহলে তার দ্বারা কেউ চিকিৎসা সেবা পাবে না। আবার একজন জ্ঞানী বা মেধাবী ব্যক্তি যদি মেধার বিকাশ না করতে পারেন বা জ্ঞানের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে না দিতে পারেন, তাহলে তার দ্বারা জাতি উপকৃত হবে না- এটা স্বাভাবিক।

এক্ষেত্রে আমরা যদি বিভিন্ন সংগঠনগুলোর কার্যক্রম দেখি তাহলে বিচিত্র জ্ঞানের বিকাশ দেখতে পাই। সেগুলোতে সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারি। হতে পারে সেটা সাংবাদিকদের কোনো সংগঠন বা কোন রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক কিংবা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ সংগঠনগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিত্ব ও মেধা বিকাশের সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্জিত জ্ঞানকে বিকশিত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ সংগঠনের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যোগাযোগের দক্ষতা অনস্বীকার্য।
(লেখক: দিদারুল ইসলাম রাসেল, সাধারণ সম্পাদক, রোটার‍্যাক্ট ক্লাব অব ইসলামিক স্টাডিজ, ইবি।)

কেমন সংগঠনে যুক্ত হওয়া উচিত?

বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থী জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ চারণভূমি। বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি জায়গা, যেখানে একজন শিক্ষার্থী তার জ্ঞান অর্জনের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে থাকে। যেখান থেকে সে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করবে, মেধা যাচাই করবে এবং নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ রূপে পরিণত করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পাঠ্য পুস্তকের জ্ঞানের বাইরে একজন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।

সংগঠনগুলো ভিন্নধর্মী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে থাকে। কোনো সংগঠন নাচ, গান, আবৃত্তি বা অভিনয়ে দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজন করে থাকে। আবার অনেক সংগঠন আছে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধির বাইরে গিয়ে দাতব্য অনেক কাজে সহযোগিতা ও সহযোগিতার মানসিকতা সৃষ্টিতে কাজ করে। যেমন- রক্ত দান, রোগ ব্যাধি প্রতিরোধে সতর্কতা বৃদ্ধি বা বিভিন্ন সময় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি। এছাড়াও যেখানে শিক্ষার্থীরা প্যাঠ্যসূচির বাইরে গিয়ে জীবনমুখী পড়াশোনা, রিসার্চ, বিতর্কসহ নানান রকম সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে। এসব মুক্ত চিন্তা ও চর্চার সঙ্গে জড়িত সংগঠনগুলোতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
(লেখক: ইয়াসিরুল কবির সৌরভ, আহবায়ক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ঐক্যমঞ্চ।)

দায়বদ্ধতা থেকেই কাজ করে সামাজিক সংগঠনগুলো

আমরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উপরে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের কিছু দায়িত্ব আপনা-আপনি অর্পিত হয়। কারণ একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য সরকার বছরে প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ করে। এ টাকা কাদের? এগুলো আমাদের আশেপাশের খেটে খাওয়া মানুষদেরই টাকা। তাদের প্রতি আমরা দায়বদ্ধ। আর এই দায়বদ্ধতা থেকেই তাদের জন্য কিছু করতে কাজ করে থাকে সামাজিক সংগঠনগুলো।

বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্নভাবে তাদের সেবা প্রদান করে থাকেন। যেমন- ল’ অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড অ্যানলাইটেন্ড সোসাইটি, আইন বিষয়ে সচেতনতা এবং আইনের আলোয় সবাইকে আলোকিত করায় এদের উদ্দেশ্য। আদালত কখনোই মানবে না, আপনি আইন জানেন না। আসলেই কি আমরা সব আইন জানি? কিন্তু এই সংগঠনটি সবাইকে আইন শিক্ষায় উদ্ভুত করতে এগিয়ে চলেছে।

স্কুল-কলেজে গিয়ে তারা বিভিন্ন সচেতনমুলক ক্যাম্পেইন করে থাকে। দেশের প্রতিটি মানুষ যেন আইনের আলোয় আলোকিত হতে পারে, সেজন্য কাজ করে চলেছে সংগঠনটি। আইনি জটিলতায় যেন কাউকে না জড়াতে হয়, সে বিষয়কে সামনে রেখে এগিয়ে চলছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ক এই সংগঠন।
(লেখক: তামান্না ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক, ল’ অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড অ্যানলাইটেন্ড সোসাইটি, ইবি।)

নেতৃত্ব শেখায় সংগঠন

নেতৃত্ব মানুষের একটি বিশেষ যোগ্যতা ও গুণ। নেতৃত্ব বলতে বোঝায়, কোনো ব্যক্তির এমন বিশেষ গুণ, যার দ্বারা মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করা যায় এবং একটি নির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করা যায়। যার মধ্যে এ ধরণের গুণাবলী আছে, তাকে বলা হয় নেতা। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাবার জন্য একজন যোগ্য নেতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কিন্তু এই যোগ্য নেতা প্রাকৃতিকভাবে বা জন্মগতভাবে হয় না। বরং বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা ও পারিপার্শিকতার ভিত্তিতে একজন ব্যক্তির ভিতরে নেতৃত্বের গুণাবলী ফুটে উঠে।

একটি চলমান সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় মানুষ সমাজ থেকে কিছু না কিছু শিখে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী বা জনকল্যাণমুলক সংগঠন।

সংগঠন ভিন্ন মানসিকতার মিলনস্থল। এখানে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই একটি কথা খুব বেশি শোনা যায়, 'আমরা প্রত্যেকে একেকজন নেতা'। যাদের প্রত্যেকের মধ্যে নেতৃত্বের গুণগুলো আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। সাধারণত সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা জনকল্যাণমূলক সংগঠনে দেখা যায়, নেতৃত্ব শেখার বা প্রদানের মানসিকতা নিয়ে সংগঠনে যুক্ত হয়। মানুষের মধ্যে শুধু নেতৃত্ব নয়, বরং সব রকমের গুণাবলি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সেগুলো বিকশিত হবার জন্য প্রয়োজন যোগ্য প্লাটফর্মের। গুণাবলি প্রকাশের প্লাটফর্মগুলোও আবার ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সংগঠনগুলো সবসময় সেই প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করে, যেগুলো সুযোগ্য নেতৃত্ব শেখায়।
(লেখক: মো. মারুফ হোসেন, সভাপতি, তারুণ্য, ইবি।)

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়