ঢাকা     শনিবার   ২৯ জুন ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৫ ১৪৩১

তারুণ্যের বিজয় ভাবনা ও আগামীর বাংলাদেশ

আশরাফুল ইসলাম আকাশ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৫, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩  
তারুণ্যের বিজয় ভাবনা ও আগামীর বাংলাদেশ

প্রতীকী

৩০ লাখ শহিদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর সাত কোটি বাঙালির পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস সংগ্রামের পথ ধরে এসেছে বাংলাদেশের মহান বিজয়। পেয়েছি একটি মানচিত্র এবং লাল সবুজের পতাকা। বিজয়ের পথ পরিক্রমায় সামনের সারিতে অগ্রণী ভূমিকা ছিলো তরুণদের। কোনো কিছুতেই দমে যাননি তরুণরা। অন্যায়, অবিচার তথা পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন অবিরাম। জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। ধ্বংস করেছে হানাদার বাহিনীর একের পর এক পরিকল্পনা।

নতুন প্রজন্মের তরুণরা বিজয় দেখেনি। কিন্তু বিভিন্নভাবে শুনেছে, জেনেছে সেই বিজয়ের গল্পকথা। বিজয় দিবসের অর্জনকে ধারণ করে নতুনদের কাছে বিজয় দিবসের কথা তুলে ধরতে হবে। পাকিস্তানিদের নির্যাতন-নিষ্পেষিত শাসন-শোষণ-বঞ্ছনা ও বৈষম্যের কথা জানাতে হবে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, তা জানলে শিউরে উঠবে তরুণ প্রাণ। দেশের প্রতি জাগবে তাদের ভালোবাসা। তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিন্তা-চেতনার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। দেশকে জানার, ভালবাসার, দেশের জন্য কিছু করার আগ্রহ কতটুকু তার ওপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যত। এই বিজয়ের মর্যাদা রক্ষা করা এবং সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব তরুণদের। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে হবে তরুণদেরই।

কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি খ্যাত বাংলাদেশ শুরুর দিকের কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো উত্থান হয়েছে সগৌরবে। বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এবং উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে আজ বিশ্বের বিস্ময়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক উন্নতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

নারী বঞ্চনার তিক্ত অতীত পেরিয়ে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক দূর এগিয়েছে। পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। ভারতের সাথে ছিটমহল বিনিময়, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা, ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

বিজয়ের ৫১ বছরে উন্নয়নের সোপান বেয়ে আমরা তৈরি করেছি গর্বের পদ্মা সেতু। ঢাকার যানবহনে নতুন গতি সঞ্চার করেছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-ফ্লাইওভার। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে দুই সিটির এক শহর। দেশে নতুন রেল নেটওয়ার্ক স্থাপিত হয়েছে। বিদুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিখাতে ব্যাপক অগ্রগতি। স্যাটেলাইট যুগে পৌঁছেছি। ৫জি চালুর দ্বারপ্রান্তে। বাজেট, জিডিপি, মাথাপিছু আয় ও রিজার্ভ বেড়েছে। ভূমিহীনদের আশ্রয়ণের ব্যবস্থা হয়েছে। দ্রারিদ্র্য বিমোচনে বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বেড়েছে। নতুন করে যোগ হয়েছে সর্বজনীন পেনশন সুবিধা। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ এবং ২১০০ সালে ‘নিরাপদ ব-দ্বীপ’ রূপরেখা গ্রহণ করা হয়েছে। ডিজিটালের কাঠামো পেরিয়ে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের পথে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ চাই, সেটি কল্পনা করতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর আশ্রয় নিতে হয় না। শেখ হাসিনার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আর স্বপ্ন নয়। সেটি আজ পৌঁছে গেছে স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে। জনসংখ্যার বোনাস যুগে পৌঁছানো বাংলাদেশের রয়েছে ক্রমবর্ধমান উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি, দক্ষ মানবসম্পদ এবং সৃজনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণি, বিপুল পরিমাণ তরুণ জনসংখ্যা এবং তাদের মধ্যে অদম্য কর্মস্পৃহার সাথে রয়েছে সরকারের নানা উদ্যোগ। তাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের এই স্বপ্ন দেখাটা খুব একটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কিন্তু পথ এখনো অনেক বাকি!

আগামীর বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রগণ্য ভূমিকায় আমাদের কৃষি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন পুরোপুরিভাবে পাল্টে যাবে। দেশের সর্বত্র মোবাইল টেকনোলজি এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন আসবে। বেকারত্বের অভিশাপমুক্ত হবে আমাদের এই স্বপ্নের বাংলাদেশ। দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে দেশেরই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশ আজ নতুন কিছু উদ্ভাবনের মাধ্যমে তার দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। শুধু পুঁথিগত নয় বরং কল্যাণমুখী এবং বাস্তবধর্মী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে এখনও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আশা করি, আগামীতে তারাও অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। নারীর প্রতি সহিংসতা, সামাজিক অনিরাপত্তা, সমাজের অসমতা ও লিঙ্গবৈষম্য পুরোপুরিভাবে নিঃশেষ হবে আগামীর বাংলাদেশে।

দুর্নীতিমুক্ত হবে দেশ, যেটি দেশের নিরাপত্তা ও উন্নতি সমৃদ্ধ করবে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশও ধীরে ধীরে তথ্যপ্রযুক্তির অনেক পথ পেরিয়েছে। তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন দেশে-বিদেশে। তথ্যপ্রযুক্তিকে আর্থসামাজিক কর্মকান্ডের সব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে সমাজ দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমাদের সোনার বাংলাসহ পুরো বিশ্ব। সেই বিপর্যয় রোধে বিশ্বব্যাপী অস্তিত্ব রক্ষার যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকায় থাকবে আমাদের বাংলাদেশ। এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখি-যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। থাকবে না অজ্ঞতা-কুসংস্কার। সমাজের কোন জনগোষ্ঠী ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গভেদে বৈষম্যের শিকার হবে না। চাই ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে মেধাপাচার, অর্থপাচার, দুর্নীতি-অনিয়ম, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৈরাত্ম্য থাকবে না।

স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি চূড়ান্তভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এরপর সেই ঐক্যে ভাটা পড়ে। বিজয়ের এতো বছর পরও জাতির অনৈক্যের সুর বাজে, যা তরুণপ্রাণকে দারুণভাবে আহত করে। তরুণ প্রজন্ম ঐক্যবদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ দেখতে চায়। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, উদার গণতন্ত্রিক চর্চা, পরমত সহিষ্ণুতা অনন্য উচ্চতায় পৌছাবে।

সড়ক দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, শিশু শ্রম, বাল্যবিবাহ, সন্ত্রাসবাদ, কালোবাজারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার কালো আলখেল্লা মুক্ত হবে দেশ। প্রশ্ন ফাঁসের মতো কোন অঘটন থাকবে না। থাকবে না মাদকের ছড়াছড়ি। ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে তথ্যপ্রযুক্তির। বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ভিত্তি করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সেই জোয়ারে নৌকা ভাসিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলের এই ব-দ্বীপটিও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, এটাই তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা। বিজয়ের চেতনায় উল্লাস ছড়িয়ে পড়ুক প্রাণে প্রাণে।

লেখক: সাবেক সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়