ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

অদম্য রাবি শিক্ষার্থী বিশ্বজিৎ

আল মাহমুদ বিজয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪২, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩  
অদম্য রাবি শিক্ষার্থী বিশ্বজিৎ

বিকলাঙ্গ দু'টি পা। মেরুদণ্ডের হাড়টাও বাঁকা। সোজা হয়ে বসতে পারেন না ঠিকমতো। জন্মলগ্ন থেকেই নিয়তি তাকে সঙ্গ দেয়নি। জন্মটাও দারিদ্র্য পরিবারে। তবে তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের কাছে হার মেনেছে সব প্রতিবন্ধকতা। তাইতো ভর্তি যুদ্ধ জয় করে তিনি চান্স পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়েও। বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) আইবিএ ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শ্রী বিশ্বজিৎ দাসের কথা।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ ইনস্টিটিউটের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। পিতা শ্যামপদ দাস ও মাতা সুষমা দাসের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। পৈতৃক নিবাস যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলাধীন সংকরপুর ইউনিয়নের রাজবাড়ীয়া গ্রামে।

ছোটবেলা থেকেই বিশ্বজিৎ প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী। শিক্ষাজীবনে প্রত্যেক পরীক্ষাতেই তার অবস্থান ছিলো প্রথম সারিতে। বাঘআছড়া ইউনাইটেড মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরিক্ষায় শার্শা থানায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। এখানেই শেষ নয়। ডা. আফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে শেষ করেন উচ্চমাধ্যমিক। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে প্রাথমিক থেকে এইচএসসি পর্যন্ত থেকেছেন বাঘআচড়া খ্রিষ্টান মিশনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেঁকে বসে মনের মধ্যে। শুরু করেন দিন-রাত বিরামহীন পরিশ্রম। ফল হিসেবে ভর্তি হওয়ার সুযোগও পেয়ে যান রাবিতে। কিন্তু আইবিএ'র নৈমিত্তিক খরচ যে বেশ মোটা অঙ্কের! এখন পড়াশোনা চলবে কিভাবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর তার পরিবারে আর্থিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। তার খরচ চালানোর সক্ষমতা পরিবারের ছিলো না। ফলে নিভে যেতে বসেছিলো তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন। তবুও বিশ্বজিৎ হাল ছাড়েননি। তীব্র বাসনা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেও নেমে পড়েন কণ্টকাকীর্ণ উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়নে।

মানুষের কাছ থেকে আর্থিক সহানুভূতি গ্রহণ তার পছন্দ ছিলো না। তাই তিনি বেছে নেন ফুডপাণ্ডায় ডেলিভারি বয়ের কাজ। নিজের মোটরচালিত হুইল চেয়ারে রাজশাহী নগরের বিভিন্ন জায়গায় খাবার পৌঁছে দেয় বিশ্বজিৎ। সারাদিনের ক্লাস-পরিক্ষা সমাপ্ত হলে সন্ধ্যা থেকে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত কাজ করে তীব্র ক্লান্তি নিয়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছায় তার কলের গাড়ি।

বিশ্বজিৎয়ের সঙ্গে কথা বিস্তারিত। জানান নিজের সফলতার গল্প। তুলে ধরেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আর আকাশছোঁয়া স্বপ্নের কথা।
পড়াশোনা শেষ করে হতে চান কর্পোরেট পার্সন। ঝুড়ি-কুলা বুনা বাবা-মায়ের দুঃখ ঘুচানোর পাশাপাশি সর্বসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন তার জীবনের অন্যতম স্বপ্ন। নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করে এ কাজ তরান্বিত করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

বিশ্বজিৎ বলেন, ‘দরিদ্র পরিবারে আমার জন্ম। পিতা-মাতা ঝুড়ি-কুলা তৈরি করেন। সেটা বিক্রি করেই কোনোমতে চলে সংসার। প্রথমে তো ভাবতেই পারতাম না বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো আমি পড়তে পারব। আমার স্কুল শিক্ষকদের থেকে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। সেদিনই দৃঢ়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন লালন করতে শুরু করি। শতবাঁধা পেরিয়ে অনেক কষ্টে স্বপ্ন জয় করেছি। এখনো অনেক সমস্যার মধ্যে আছি। তারপরও সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি যা পেয়েছি, তা অনেক সুস্থ-সবল মানুষও পায়নি।’

বিশ্বজিৎ আত্মনির্ভরশীলতার কথা তুলে ধরে আরও জানান, কারো থেকে সাহায্য নেবেন না তিনি। নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য এখন ফুড ডেলিভারির কাজ করেন। আগামীতে টিউশনি পেলে করবেন অথবা ল্যাপটপ কিনে ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের খরচ বহন করবেন।’

বিশ্বজিৎ দাসের সহপাঠী তন্ময় কুন্ডু বলেন, ‘বিশ্বজিৎ ক্যাম্পাসে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। শারীরিক ও আর্থিক প্রতিকূলতার পরও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সমাজে বিরল। এ অবস্থার মধ্যেও বিশ্বজিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করায় আমরা খুশি।'

কথা হয় বিশ্বজিৎয়ের গর্বিত পিতা শ্যামপদ দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমার ছেলেকে ঠিকমতো টাকা দিতে পারি না। ওর চেষ্টা ও আগ্রহে আজ এই পর্যন্ত গেছে। ওর স্বপ্ন পূরণে আপনারা আর্শীবাদ করবেন।’

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়