ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

সংকটে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম

এমদাদুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩  
সংকটে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ২৮ লাখ টাকা বেশি। এদিকে মান বাড়লেও গবেষণায় পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব, বিভিন্ন জার্নালে গবেষণা প্রকাশের ক্ষেত্রে সামর্থ্যের বাইরের এডিটিং ফি-সহ নানা ধরনের সংকটে চলছে কুবির গবেষণা কার্যক্রম।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুবিতে ২০২১ সালে ১৯ বিভাগে মোট ২২৯টি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। যেটা ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৩১০ এ। যা গবেষণায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আগ্রহী হয়ে উঠার বিষয়টি নির্দেশ করে। তবে ল্যাবগুলোর ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি, হাই কনফিগারেশন কম্পিউটার ও উন্নতমানের সফটওয়্যারের অভাব, ডেটা স্বল্পতা এবং অর্থায়ন জটিলতার জন্য নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম না থাকায় গবেষকদের গবেষণা কাজের জন্য শরণাপন্ন হতে হচ্ছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের। যার ফলে গবেষণার সময় বেশি লাগছে এবং খরচও বাড়ছে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে সরঞ্জাম না থাকায় গবেষণার কাজে ঢাকামুখী হতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো: আবুল মাজেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘একেক গবেষণার ক্ষেত্রে একেক রকম সাপোর্ট দরকার। তবে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক সময় পর্যাপ্ত সাপোর্ট পাওয়া যায় না। একটা গবেষণা শেষ হয়ে যখন রিপোর্ট আকারে প্রকাশ করতে হয়, তখন অনেক ধরনের ডেটা দিতে হয়। এক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অংশ ব্যবহার করতে পারি। বাকি অংশ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর সঙ্গে আমাদের এমওইউ (সমঝোতা চুক্তি) করা আছে, তাদের থেকে নিয়ে থাকি। এর বাহিরে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই বলে আমরা সেই সাপোর্টটা পাই না। এক্ষেত্রে তথ্য পেতে সময় বেশি লেগে যায়।'

গবেষণা ক্ষেত্রে উন্নতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এক্সআরডি, এক্সট্রা ডিকটেশন, রামান, সেকেন্ডারি স্টেথোস্কপির মতো কিছু দামি যন্ত্রপাতি কয়েকটি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কিনে রাখতে পারে। এর ফলে যেই গবেষণাগুলো এক বছরের মতো লাগত, তা কয়েক মাসের মধ্যে হয়ে যাবে। তাহলে আমরা একটা গবেষণার প্রজেক্ট শেষ করে আরেকটা গবেষণার প্রজেক্ট শুরু করতে পারব। গবেষণার পর যখন প্রকাশনা করব, তখন মাইক্রোসফট অফিস বা বিভিন্ন ফটো এডিট বা ডিজাইনিং এর মতো লেটেস্ট সফটওয়ার দরকার হয় ভালোভাবে প্রেজেন্ট করার জন্য। যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।'

রসায়ন বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ফাতেমাতুজ জোহরা জানান, 'আমাদের ডিপার্টমেন্টের ল্যাবগুলো এখনো ওতো সমৃদ্ধ না হলেও আমাদের ফিজিক্যাল ব্রাঞ্চে যা আছে, তা দিয়ে আমরা গবেষণার কাজ করে থাকি। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন ডেটা অ্যানালাইসিস, এক্সট্রা-ডিসেন্ট করার জন্যে আমরা এগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে হয়। আমাদেরকে স্যাম্পল পাঠানোর জন্যে ঘন ঘন ঢাকা যেতে হচ্ছে। এটা এক ধরনের অন্ধকারের মধ্যে কাজ করার মতো। যদিও আমাদের শিক্ষকরা তাদের যথাসাধ্য সাপোর্ট দিচ্ছে। তাছাড়া বুয়েট এ ফ্যাম আছে। বিসিএসআর (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ), এটোমিক এনার্জি এবং দেশের বাইরে যেমন- জাপান, মালেশিয়ার মতো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যাম্পল পাঠিয়ে আমরা ডেটা সংগ্রহ করি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সট্রা ডিসেন্ট মেশিন নেই বলে সেসব জায়গায় পাঠাতে হচ্ছে।'

গবেষণার সরঞ্জাম যেমন নেই, তেমনি ল্যাবে কাজ করার মতো যথাযথ টেকনিক্যাল সাপোর্টেরও অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের আইসিটি ভিত্তিক গবেষণার জন্য হাই কনফিগারেশনের সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে সেসব সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য হাই কনফিগারেশন এর কম্পিউটার প্রয়োজন হয়। যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অপ্রতুল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের ডেটা সংগ্রহ করতে হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় আমাদের বাংলা ভাষায় ডেটা কম। যদি বাংলা ভাষার ডেটা পাওয়ার উপায় তৈরি করা যেত, তাহলে আমাদের জন্যে আরও সুবিধা হতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে যেসব জার্নালের অ্যাকসেস আছে তা গবেষণার জন্যে ব্যবহার করতে পারছি। কিছু জার্নালের মেম্বারশিপ থাকায় কোনো কোনো রিসার্চ পেপার ডাউনলোডও করা যাচ্ছে। এছাড়াও কিছু ওপেন জার্নাল আছে। সেখান থেকেও আমরা রিসার্চ পেপার কালেক্ট করতে পারি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকরা অন্যান্য কিছু সাইট থেকে জার্নাল কিনে গবেষণার জন্যে ব্যবহার করে থাকে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘ল্যাবের সরঞ্জাম যদি আরও একটু বেশি থাকত, তাহলে ভালো হতো। যেমন- আমাদের ল্যাবে একটা ওভেন আছে, আরও কয়েকটা ওভেন থাকলে ভালো হতো। পাশাপাশি মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব আরও অত্যাধুনিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে ভালো হতো। এছাড়া আমাদের কম্পাউন্ড আইসোলেশন করার সময় ভালোমানের কোমাটোগ্রাফি দরকার হয়। পাশাপাশি বিসিএমএস করার জন্য এক্সপেন্সো মেশিন একটা আছে। যা ভালোভাবে ব্যবহার না করায় মাঝে মাঝে নষ্ট হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণার অর্থায়ন আরেকটু সুবিধাজনক হলে ভালো হতো। কারণ একটা ব্যাচের গবেষণার অর্থায়ন এক বছরের মতো দেওয়া হলেও সেই এক বছর শেষ হতে হতে আরেক ব্যাচের গবেষণা শুরু হয়ে যায়। তখন নিজেদের অর্থ দিয়ে গবেষণার কাজ সম্পূর্ণ করতে হয়।’

তবে সম্প্রতি গবেষণা জার্নালে প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাহেদুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য জার্নালে প্রকাশের যে খরচটা, সেটা বহন করা বেশ কঠিন। কেননা জার্নালভেদে এই খরচ ৬০০ ইউএস ডলার থেকে শুরু করে ৪ হাজার ইউএস ডলার পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং উপাচার্য স্যার এই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়ার এই উদ্যোগ নিয়েছেন। আশা করছি এই উদ্যোগের ফলে আমরা যারা গবেষণা করছি তারা অনেক উৎসাহ পাব আরও কাজ করার।’

সরঞ্জামের ঘাটতি এবং ল্যাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরঞ্জাম না থাকার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এফএম আবদুল মঈন বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংস্থার সঙ্গে গবেষণার সরঞ্জামের সহায়তার জন্য চুক্তি করেছি। কিছু জিনিসের অনেক দাম। সেগুলো বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কেনা সম্ভব না। তবে গবেষণা যেনো থেমে না থাকে সেজন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি এবং এর জন্য আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবে গবেষণার জন্য যদি প্রয়োজন হয় এমন সরঞ্জামের তালিকা দিলে সেটা আমাদের পক্ষে কেনা সম্ভব হলে আমরা কিনে দিচ্ছি। কিন্তু কিছু জিনিস আছে যেগুলো কেনা সম্ভব না। কারণ আমাদের বাজেট স্বল্পতা আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষকদের গবেষণার জন্য যে এডিটিং ফি দিতে হয় সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে দেওয়ার জন্য একটি ফান্ড আমি আসার পরেই শুরু করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় শুধু একজন শিক্ষক সে ফান্ড থেকে সহায়তা নিয়েছে গত এক বছরে। আমি শিক্ষকদের আবার চিঠি দিয়েছি এই ফান্ড যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্য।’

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়