ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৮ ১৪৩১

ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ

শহীদুল ইসলাম (শুভ) || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৭, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩  
ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ

জাতিতে গৌরবে উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য উন্নয়নের রোল মডেল। উন্নয়নের এক মাইলফলক আমাদের বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে জান দিয়ে মান রক্ষা করেছে, রক্ষা করেছে রক্ত দিয়ে জাতিকে, দেশকে এবং নিজেদের স্বাধীনতা। যেই জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। আজ সেই জাতি তাদের দিক থেকে এগিয়ে।

শূন্য থেকে শুরু করা দেশের অর্থনীতি এখন দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, নারীর ক্ষমতায়নে, মাতৃমৃত্যু রোধে ইত্যাদিতে ভারত পাকিস্তানকে টপকিয়ে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে। দেশের এতো অর্জন, এতো গৌরব আমাদেরকে বিশ্ব দরবারে এক অনন্য জায়গা করে দিচ্ছে। বাঙালিরা পাচ্ছে নিজস্ব বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্লাটফর্ম।

একটি দেশ কতোটা এগিয়ে তা বোঝা যায় মাথাপিছু আয় এবং জিডিপির অনুপাতে। এছাড়াও অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয় আছে। বাংলাদেশ এখন মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে কয়েক বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও সমৃদ্ধ হচ্ছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সব থেকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক বড় শক্তি হলো ভারত ও পাকিস্তান। তাদেরকে পিছনে ফেলে বর্তমান বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ টানা চার বছর ধরে ভারতের মাথাপিছু আয়কে পিছনে ফেলে এগিয়ে আছে। যেখানে পাকিস্তানকে আরও আট বছর আগেই পিছনে ফেলে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের জিডিপি ভারত পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) হলো একটি দেশের অভ্যান্তরের উৎপাদন ও সেবা সে দেশের মানুষের সমভাবে ভাগ করে দেওয়া। দেশের অভ্যান্তরে যে উৎপাদন হয় তা নাগরিকদের প্রাপ্য। সে দিক দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। বাংলাদেশের জিডিপি ২ হাজার ৬২১ ডলার। ভারতের জিডিপি ২ হাজার ৬১২ ডলার। পাকিস্তানের জিডিপি ১ হাজার ৪৭১ ডলার। এই জিডিপি কিন্তু বাহিরের আয়কে অন্তর্ভুক্ত করে না।

একটি ছোট্ট জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের অভ্যান্তরে এমন উৎপাদন দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য গৌরবের। তারা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হবে। দেশের সিংহভাগ উৎপাদন এখনো প্রাচীন পদ্ধতিতে করা হয়। ফলে অনেক জায়গায় সময় মতো তাদের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনের ফসল পেতে পারে না। যদি আধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক করা হয় তাহলে দেশের অভ্যান্তরের উৎপাদন আরও বাড়বে। জিডিপিও এগিয়ে যাবে।

মাথাপিছু আয়ের দিক থেকেও বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। মাথাপিছু আয় হলো দেশের ভিতরে ও বাহিরের আয় একত্রিত করে দেশের মানুষের সমভাবে ভাগ করে দেওয়া। দেশের জনগণ দ্বারা উৎপাদিত এবং প্রবাসী আয় এগুলোও মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের ৯৬ শতাংশ দেশের ভিতরে উৎপাদিত হয়। মাথাপিছু আয় এক দশকে এগিয়ে গেছে বেশি।

২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৩১৬ ডলার। ২০২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। ২০২০ সালে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতকে পিছনে ফেলে। ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। সে বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হয় ১ হাজার ৮৮৮ ডলার। জরিপে দেখা যায় ভারত কোভিডের কারণে পিছিয়ে পড়ে। সেখানে বাংলাদেশ কোভিডের মধ্যেও এগিয়ে গেছে। যে ভারত ২০০৪ সালে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ থেকে ৭০% এগিয়ে ছিলো। ২০০৭ সালে অর্ধেক বেশি ছিল। ২০২০ সালে বাংলাদেশ ভারতকে পিছিয়ে দেয়। বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। দেশ উন্নয়নে কী ব্যাপক হারে এগিয়ে যাচ্ছে তা উক্ত সূচকে ধারণা পাওয়া যায়।

যে দেশ ১৯৭১ সালে আমাদের উপর নির্মম গণহত্যা চালিয়ে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিলো, সেই পাশবিক নিষ্ঠুর দেশকে মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে ২০১৬ সালেই পেছনে ফেলে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিলো ১ হাজার ৪৬৮ ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিলো ১ হাজার ৬৫৯ ডলার। ২০২৩ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৭১ ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু ২ হাজার ৬২১ ডলার। আজ তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মডেলকে আদর্শ হিসেবে দেখে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তাদের দেশে মূল্যায়ন করে।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের ক্রয় ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। ক্রয় ক্ষমতা তখনই বেশি হয়, যখন ওই দেশের সম্পদ বেশি হয়। যে দেশের সম্পদ বেশি সে দেশের ক্রয় ক্ষমতাও বেশি হবে। ক্রয় ক্ষমতা নির্ধারণ করে পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) পদ্ধতিতে।

এছাড়াও বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেশি। ২০২৩ সালের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের ৮ হাজার ৬৭০ ডলার। ভারতের ৯ হাজার ১৮০ ডলার এবং পাকিস্তানের ৬ হাজার ৭৭০ তলার (সূত্র: আইএমএফ)। এদিক দিয়ে পাকিস্তান থেকে বেশি হলেও ভারত থেকে কিছুটা কম। তবে খুব শীঘ্রই ভারতকেও পিছনে ফেলে দুর্বার প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাবে সোনার বাংলাদেশ।

নারী ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বের জন্য আদর্শ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে নারীর কর্মসংস্থানের জন্য ভয়ের কাজ করে, সেখানে বাংলাদেশ নারীর কর্মসংস্থানের জন্য বড় বড় প্লানিং বাস্তবায়িত করেছে। ভারত পাকিস্তান এতো শক্তিশালী দেশ হয়েও নারীর কর্মশালা করতে পারছে না। বাংলাদেশ তা অনায়াসে করছে। কর্মশক্তিতে বাংলাদেশ প্রতি তিনজনে একজন নারী। প্রায় আড়াই কোটি নারী নানান পেশায় নিয়োজিত।

কর্মশক্তির শতকরা ৩৫ শতাংশ নারী। যেখানে ভারতের নারী কর্মশক্তি শতকরা ২৩ শতাংশ এবং পাকিস্তানের শতকরা ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ নারীর জন্য নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে তারও ইতিবাচক দিক। সমাজ রক্ষণশীল হওয়ায় নানান বেগ পেতে হয় নারীদের। তবুও নারীর প্রতি বাংলাদেশ সমতা রক্ষা করে।

সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশ বড় সাফল্য এনেছে। ভারত পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশিরা এখন বেশি বেঁচে থাকে। ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। পাকিস্তানের গড় আয়ু ৬৯ বছর। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৪ বছর। দেশে যখন শান্তি, শৃঙ্খলা ও সুখের ছায়া পড়ে তখনই মানুষ নানান দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকে। দুশ্চিন্তা মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দেয়। বাংলাদেশিদের গড় আয়ু দেখে বোঝা যাচ্ছে তুলনামূলক মানুষ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত।

শুধু সামাজিক সূচকেই নয়, সাক্ষরতার হারও ভারতের সমপর্যায় এবং পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের সাক্ষরতার হার ৭৭% এবং পাকিস্তানের সাক্ষরতার হার ৫৯%। মাতৃমৃত্যু, প্রজনন হার ও শিশুমৃত্যুর হার পূর্বের তুলনায় বাংলাদেশ এখন অনেক সাফল্য এনেছে। যেখানে ২০০০ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যুর হার ছিলো ৪৪১ জন, ২০০৫ সালে ৩৭৬ জন, ২০১০ সালে ৩০১ জন, ২০১৫ সালে ২১২ জন, ২০২০ সালে ১২৩ জন মারা যেত। আজ বাংলাদেশ তারও বড় সাফল্য এনেছে।

বাংলাদেশ সরকার যে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। ইতোমধ্যে অনেক বড় বড় মেগা প্রজেক্ট দৃশ্যমান হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মাসেতু, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন, মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি চলমান। এছাড়াও বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি হিসেবে প্রবেশ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, মাতার বাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর ইত্যাদির কাজ প্রায় শেষ। ১২১টি মেগা প্রকল্প, লিঙ্গ সমতা,দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, রপ্তানীমুখী শিল্প, ১০০টি অঞ্চলকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প ইত্যাদিতে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। এসব দেশের অর্জন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের পদার্পণে দেশের অর্জনকে একজন নাগরিক হিসেবে শ্রদ্ধা করি। এ সত্ত্বেও দেশের কিছু দুর্নীতিবাজ দেশকে ভিন্ন দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। দেশের সম্পদ পাচার করে বিদেশে অট্টালিকা তুলছে। তাদের আইনের আওতায় এনে রাষ্ট্রীয় সাজা দেওয়া উচিত। সরকারি প্রত্যেক মহলে জবাবদিহিতার অবাধ সুযোগ রাখা উচিত। তখন দেশ আরও সুন্দর হবে, আরও দ্রুত সমৃদ্ধ হবে।

(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।)

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়