ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

ফিরে দেখা চবি-২০২৩ 

আকিজ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৬, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩  
ফিরে দেখা চবি-২০২৩ 

বহমান সময় স্রোতে ভেসে পেরিয়ে গেল আরও একটি বছর। ক্যালেন্ডারের পাতায় নতুন সংখ্যা হয়ে আসছে ২০২৪। বছরের হিসেবে প্রতিটিই ঘটনাবহুল। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও (চবি) ঘটে গেছে ইতিবাচক নেতিবাচক নানা ঘটনা। এসবের কোনটি আলোচনায় এসেছে দেশ জুড়ে। আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠটির কেমন কাটলো ২০২৩- এসব কিছুই থাকছে এই প্রতিবেদনে।

চবিতে প্রথম গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রকাশনা মেলা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণার বৈচিত্র্যকে সবার সামনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র এবং চিটাগাং ইউনিভার্সিটি রিসার্চ অ্যান্ড হায়ার স্টাডি সোসাইটির (সিইউআরএইচএস) যৌথ উদ্যোগে প্রথমবারের মতো 'চট্টগ্রাম রিসার্চ ফেস্টিভ্যাল' শীর্ষক মেলা আয়োজিত হয়। এ মেলায় অংশ নেয় চবির ৩১টি বিভাগ, ২৪টি ল্যাবরেটরি এবং চট্টগ্রাম বিভাগের আরও ২০টি প্রতিষ্ঠান। ফেস্টিভ্যালে ৪০ জন সেরা গবেষককে পুরস্কৃত করা হয়।

মেরিন সায়েন্স ইন্সটিটিউট ভবন উদ্বোধন

মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের একাডেমিক ভবন উদ্বোধনে চবিতে আসেন শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি। জমকালোভাবেই উদ্ভোদন করা হয় দেশের একমাত্র সমুদ্র গবেষণার জন্য স্থাপিত অত্যাধুনিক ভবনটি। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৪০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। যা নিয়ে ইউজিসি থেকে আপত্তি ও কারণ জানতে চাওয়া হয়।

চবি শিক্ষার্থীর তৈরি ভোকাবুলারি অ্যাপস

চলতি বছরে চবির ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আশরাফুল ইসলামের তৈরি অ্যাপস আলোচনায় আসে। তৈরিকৃত ট্রান্সলেটের স্টুডিও অ্যাপসটির মাধ্যমে পৃথিবীর বহু ভাষা অনুবাদ করা যায় এবং কোনো ছবিতে কিছু লেখা থাকলে সেটি ‘টেক্সট’-এ রূপান্তর করা যায়। আরেকটি অ্যাপ হলো বাংলা অক্সফোর্ড থ্রি থাউজেন্ড ভোকাবুলারি অ্যাপস।

দেশের প্রথম আইন সম্মেলন

‘পরিবর্তনশীল বিশ্বে আইন’- প্রতিপাদ্যে চবিতে দু’দিনব্যাপী দেশের প্রথম ‘জাতীয় আইন সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশ-বিদেশের ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০জন গবেষক তাদের গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

চবির দর্শন বিভাগের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন

সুবর্ণজয়ন্তীতে দর্শন বিভাগের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো ‘Philosophy: Now and Here’- প্রতিপাদ্যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে মোট ৭টি একাডেমিক সেশনে মূল প্রতিপাদ্যে ৫টি বিষয়বস্তু যথাক্রমে 'পলিটিক্স, পিস, অ্যান্ড জাস্টিস', 'এথিকস ইন দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড', 'ফিলোসফি অ্যান্ড এডুকেশন', 'মেটাফিজিক্যাল ইনকুইরিজ ইন দ্য কনটেমপরারি ওয়ার্ল্ড' এবং 'ফিলোসফি: ইন্টার ডিসিপ্লিনারি পারসপেকটিভ' এর ওপর মোট ৩৫টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।

বিশৃঙ্খল ছাত্রলীগে অস্বস্তি প্রশাসনে

বছর জুড়েই আলোচনায় ছিলো চবি শাখা ছাত্রলীগ। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিটি নিয়ে বিরোধ, দফায় দফায় সংঘর্ষ, মূল ফটকে তালা দেওয়া, নিয়োগে হস্তক্ষেপ, সাংবাদিক হেনেস্তা এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নানাবিধ অভিযোগে অভিযুক্ত হয় চবি ছাত্রলীগ।
গণমাধ্যমের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত এক বছরে অন্তত ১২ বার অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে সংঘর্ষে জড়িয়েছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছে শতাধিক নেতাকর্মী। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশল কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের পদধারী এক নেতার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবারাহ বন্ধ করে দেয় প্রকৌশল ও নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তারা।

এর আগে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিতে এসে শাখা ছাত্রলীগের একাংশের মারধরের শিকার হন এক নিয়োগ প্রত্যাশী। নিজেদের এক কর্মীকে নিয়োগ না দেওয়ায় উপাচার্য কার্যালয়ে ভাঙচুর করে শাখা ছাত্রলীগের একটি উপগ্রুপ। এছাড়াও নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিরোধে অন্তত পাঁচবার  বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক তালা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও প্রশাসন থেকে লোক দেখানো শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তবে এ বছরের শুরুতে গত বছর সংঘর্ষ ও মারধরের পাঁচটি ঘটনায় ছাত্রলীগের ১৭ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছিলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

শাটল দুর্ঘটনায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রশাসনের মামলা

চলতি বছর সেপ্টেম্বরে শাটল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে চবির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। শাটল ট্রেনের ছাদে যাতায়াতের সময় গাছের আঘাতে কয়েকজন শিক্ষার্থী মারাত্মক আঘাত পান। এ ঘটনায় একজনের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে মুহুর্তেই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ফুসে ওঠেন। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবন, পুলিশ ফাঁড়ি ও নিরাপত্তা দপ্তরে ব্যাপক ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারীদের যাতায়াতের শতাধিক বাস ও মাইক্রবাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ ঘটনায় জামাত শিবিরের মদদ আছে বলে ছাত্রলীগ থেকে অভিযোগ করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে ১২ জনকে আসামী ও ৯০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে যে মামলা করা হয়, তাতে দেখা যায় ১২ জন আসামীর ১০ জনই শাখা ছাত্রলীগের কর্মী।

চারুকলা স্থানান্তরে শিক্ষার্থীদের দাবিতে প্রশাসনের 'না'

চারুকলা ইনস্টিটিউটকে মূল ক্যাম্পাসে ফেরানোর দাবিতে ওই অনুষদের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। গত বছর শুরু হওয়া এই আন্দোলনের মিমাংসা করতে  শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী দুজনই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরও আন্দোলন না থামায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় অনুষদটি। তবে এই আন্দোলনে বাধাদানের অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

অর্ধযুগ পরে ছাত্রদলের কমিটি, বিলুপ্ত ছাত্রলীগ

প্রায় অর্ধযুগ পর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। সাত সদস্যের আংশিক এই কমিটি নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও সময়ে সময়ে ঝটিকা মিছিলে ক্যাম্পাসে বেশ আলোচনার জন্ম দেয় তারা। অন্যদিকে দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটির দাবিতে শাখা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ আন্দোলন করলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কয়েকদিনের মধ্যেই সেটা বিলুপ্তের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপগ্রুপ। এক পর্যায়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতিকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। সাংবাদিক হেনেস্তা ও পূর্বের বহুবিধ অভিযোগের জেরে ২৪ সেপ্টেম্বর হঠাৎ চবি শাখা ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

অব্যহত ছিলো সাংবাদিক হেনেস্তা

এ বছর বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে সংবাদ সংগ্রহের সময় পাঁচজন সাংবাদিক হেনেস্তার শিকার হন। সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদককে মারধর করেন শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতির অনুসারীরা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও পূর্বের নানান অভিযোগে এ দিনই চবি শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

প্রাধ্যক্ষ-প্রক্টরসহ একযোগে ১৬ জনের পদত্যাগ

২০২৩ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে হঠাৎ পদত্যাগ করেন হল প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টরসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ১৮টি পদে থাকা ১৬ জন ব্যক্তি। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলেও উপাচার্য জানান, ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ওই কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছেন।

নিয়োগ নিয়ে প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতি মুখোমুখি

নিয়োগ নিয়ে এ বছরেও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে চবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে। বছরের একেবারে শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ও আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে সোচ্চার হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। একই সঙ্গে তারা প্রশাসনের বিপক্ষে অবস্থান নেন সমিতির শিক্ষক নেতৃবৃন্দ। এ সময় নেতৃবৃন্দ উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের মুখে নিয়োগ বোর্ড বাতিল করেন উপাচার্য। এতে করে উপাচার্যপন্থী ও উপাচার্য বিরোধী শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে।

এর আগে পালি বিভাগে অযোগ্য প্রার্থী নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনায় এসেছিল চবি। সমালোচনার মুখে ওই সময় তা বাতিল হয়।

থামেনি আত্মহত্যা

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশাগ্রস্থ হয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছর ঘটেছে আত্মহত্যার ঘটনা। ঝরে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের চার মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রাণ। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তবে গেল বছরের তুলনায় আগামী বছর আরও ভালো কাটুক এমন প্রত্যাশা চবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের। পুরনো ভুলগুলো পুনরাবৃত্তি না করে নতুন করে সামনে এগিয়ে যেতে চান চবি পরিবার।

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়