ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

পরিবেশ দূষণ ও আমাদের পর্যটন শিল্প

শাহ আরুফা জাফনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৪, ১ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৮:২০, ১ জানুয়ারি ২০২৪
পরিবেশ দূষণ ও আমাদের পর্যটন শিল্প

২০১৮ সালে সপরিবারে কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সুন্দর সমুদ্র সৈকত, লঙ্ঘিনী সুন্দরী দ্বীপ এবং দীর্ঘক্ষণ সূর্যাস্তের দৃশ্যসহ সবই মনোমুগ্ধকর। অথচ প্রকৃতির এ অপার সৌন্দর্য্য আজ দূষিত হচ্ছে পর্যটকদের যত্রতত্র ডাবের খোসা, অপচনশীল পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি ফেলার কারণে।

দেশে অবকাশকালীন ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের শীর্ষ পছন্দের তালিকায় রয়েছে কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ইত্যাদি। এ কারণে হোটেল-মোটেলসহ পর্যটনকেন্দ্রিক বিভিন্ন বিনিয়োগও সেখানেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আবার সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারির সীমাবদ্ধতায় এসব এলাকায় পরিবেশগত ক্ষতিও হয়েছে মারাত্মকভাবে। শুধু তা-ই নয়, গোটা দেশেই বনাঞ্চল, জলাভূমি, পার্বত্যাঞ্চল ও সৈকতকে ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলো দূষণ ও প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ পর্যটনকেন্দ্রে নেই পর্যাপ্ত ডাস্টবিন। ফলে পর্যটকদের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য।

দিগন্ত জুড়ে সবুজের পটভূমি, বাংলার ভূ-খণ্ডের বুক চিরে ছুটে চলা অসংখ্য ছোটবড় নদী, পূর্ব সীমান্তের পাহাড়ের সৌন্দর্য্য, দক্ষিণের ম্যানগ্রোভ বন ও সমুদ্র সৈকত, বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা- যা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব দর্শনীয় স্থানসহ হাজার বছরের ইতিহাসের বাহক নানা পুরাকীর্তি দেশি বিদেশি পর্যটকদের বিষ্মিত ও বিমোহিত করে।

রোমাঞ্চকর পর্যটনের জন্য সেরাদের তালিকায় অন্যতম পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঝর্ণা সমূহের ট্রেকিং ও হাইকিং, সুন্দরবন, কাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকার ও সমুদ্রতীরে ঝাউবনে তাঁবুবাস। এর সবকিছুই পর্যটকের রোমাঞ্চিত ও ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে বাড়িয়ে তোলে।

এছাড়াও বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত পর্যটন কেন্দ্রগুলো মধ্যে অন্যতম ঢাকার লাগবাগ দুর্গ, কুমিল্লার ময়নামতি, পাহাড়পুর বিহার, সোনারগাঁয়ের পানাম নগর, মহাস্থানগড়, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, জাতীয় জাদুঘর এবং বাঙালি জাতির রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার পর্যটকদের আনাগোনায় সারাবছর মুখরিত থাকে।

অথচ দেশের প্রধান পর্যটন অঞ্চলগুলোর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যই আজ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ। পরিবেশ অধিদপ্তর বর্তমানে মোট ১৩টি স্থানকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে । দিনদিন এসব পর্যটন এলাকা প্রতিবেশগতভাবে আরও বিপন্ন হয়ে পড়ছে, যা এসব এলাকায় টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক পিছিয়ে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশের পর্যটন শিল্প এগোয়নি। মুন্ডি র‍্যাঙ্কিংয়ের মতে, পর্যটন শিল্পে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম। আর এশিয়ার ৪৬টি দেশের মধ্যে ৪২তম।

মুন্ডি র‌্যাঙ্কিংয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছে ছয়টি এবং এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত হিসেবে পর্যটন শীর্ষে। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২০০ মিলিয়নে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৩ দশমিক ০২ শতাংশ। যা আকারে ৭৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, পর্যটন শিল্প থেকে ১০ শতাংশ জিডিপি অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে ঘিরে বহু বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রায় দশ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

পর্যটন বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু বাংলাদেশ পর্যটন ব্যালান্স শিটের দায়বদ্ধতার পাতায় দেখা যায়, এ শিল্প আসলেই বেশকিছু ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে রসদ জোগাচ্ছে। পর্যটন শিল্পে অন্যান্য শিল্পের চেয়ে পানির খরচটা বেশি হয়। পর্যটন স্থানীয় মানুষের খাদ্য, এনার্জি ও অন্যান্য কাঁচামালের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আসলে পর্যটনকে নয় বরং পর্যটকদের আচার-আচরণ ও ব্যবহারবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক আইনের।

কিন্তু বাংলাদেশের পর্যটনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত ১৫-১৬টি আইন ও নীতিমালা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুলিখিত ধারা খুঁজে পাইনি, যেখানে পর্যটকদের আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা রয়েছে। পর্যটন শিল্প জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে সঠিক পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বর্তমানে সরকার সুন্দর সুন্দর প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু মানসম্মত প্রকল্প বাস্তবায়ন এই ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও বিভিন্ন জেলায় বিনোদন ও থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা থাকলে পর্যটন শিল্প প্রসার লাভ করবে। আর বিদেশিদের জন্য দরকার নিরাপদ সড়ক, সুন্দর থাকা-খাওয়ার হোটেল-মোটেল এবং পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

বাংলাদেশের পর্যটনের টেকসই বিকাশ এবং উন্নয়নে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ পর্যটন বিকাশে গতি আনতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের পর্যটন শিল্পের প্রচার ও উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ট্যুর অপারেটর, হোটেল ও এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের দেশ সবুজ। সবুজের সঙ্গে বিনোদন যোগ করতে পারলে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে। তাই সরকারের উচিৎ, পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারসহ সারাদেশে কিছু কিছু অংশে উন্নয়ন ঘটাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া। সর্বোপরি এ শিল্প বিকাশে সুন্দর, দূষণমুক্ত, গুণগত মানসম্পন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রয়োজন।

লেখক:  শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, প্রথম বর্ষ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস (বিইউপি)।
 

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়