ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

আবাসিক হল উদ্ধারে উদাসীন জবি প্রশাসন

জবি সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:০২, ৩ জানুয়ারি ২০২৪  
আবাসিক হল উদ্ধারে উদাসীন জবি প্রশাসন

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ১৮ বছর পার করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) একটিমাত্র ছাত্রী হল দিয়ে অনাবাসিক তকমা ঘুচালেও নেই পুরোপুরি আবাসন সুবিধা। তবে কলেজ থাকা অবস্থায় ছিলো আবাসন সুবিধা। সেসব হল বর্তমানে রয়েছে বেদখলে। তিন যুগের বেশি সময় পার হলেও এখনো সেসব হলের দখল পায়নি জবি কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষার্থীদের নানা আন্দোলন সংগ্রামের পরও সেসব বুঝে পায়নি প্রশাসন। নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শুরু হওয়ায় দখল হওয়া আবাসিক হল নিয়ে অনেকটাই উদাসীন প্রশাসন।

জানা গেছে, ২০০৯, ২০১১, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে আবাসিক হলের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। স্থানীয় ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অনেকেই রক্তাক্ত হন, সেই তালিকায় বাদ যাননি শিক্ষকরাও। ২০১১ সালে তীব্র আন্দোলনের পর ছাত্রীদের জন্য আবাসিক হল নির্মাণের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন কারাগার কেরাণীগঞ্জে স্থানান্তর করা হলে সেই জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল নির্মাণের দাবিতে ২০১৬ সালে আবারো আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ফলশ্রুতিতে ২০১৬ সালে কঠোর আন্দোলনের ফলে কেরাণীগঞ্জের তেঘরিয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য ২০০ একরের নতুন ক্যাম্পাসের ঘোষণা দেয় সরকার।

কেরাণীগঞ্জের নতুন ক্যাম্পাসের কাজ এগিয়ে চলছে কচ্ছপ গতিতে। বার বার মেয়াদ বাড়িয়েও নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারছে না প্রশাসন। নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের ঘোষণার পর অনেকটাই আড়ালে চলে যায় জবির দখল হওয়া হলের আলোচনা। পরবর্তীতে ২০২০ সালের অক্টোবরে ছাত্রী হল চালুর পরই আবারো দখল হওয়া হল উদ্ধারের দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা।

জবি সূত্রে জানা গেছে, প্রাক্তন জগন্নাথ কলেজের অধিকাংশ হল ছিলো স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে পুরান ঢাকার হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ি। সেই সময় জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতারা এগুলোকে ছাত্রাবাসে পরিণত করেন। হলগুলোর নামকরণ করেন বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা কলেজের অধ্যক্ষদের নামে।

সর্বপ্রথম আরমানিটোলার শহীদ আব্দুর রহমান হলের ওপর দখলদারদের দৃষ্টি পড়ে। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম নামের এক দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে একাধিকবার এই হলের দখল নেওয়ার চেষ্টা করলেও সে সময় শিক্ষার্থীরা তা রক্ষা করেন। তবে ১৯৮৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয়দের সঙ্গে এই হলের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আটটি হল বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে কলেজ সংলগ্ন শহীদ আজমল হোসেন হলটিও দখল করে নেয় প্রভাবশালীরা।

১৯৮৮ সালের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকার কেরানীগঞ্জে জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের ‘রানা হল’ নামে একটি ছাত্রাবাস ছিল। সেটাও দখল করে নেয় প্রভাবশালীরা।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব আবাসিক হল রয়েছে, তার বেশিরভাগই স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে।  অনেক হলের কাগজপত্রও নিজেদের নামে করে নিয়েছে তারা।

‘মাহমুদা স্মৃতি ভবন’ নামে ছাত্রদের একটি হল ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের স্থানে। পুরাতন বিভিন্ন ছবিতেও হলটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বর্তমানে কলা অনুষদের একাডেমিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘এরশাদ হল’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হল।

২০১১ ও ২০১৪ সালে আবাসিক হলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে গোপীমোহন বসাক লেনের ‘শহীদ নজরুল ইসলাম হল’ ও মালিটোলায় অবস্থিত ‘ড. হাবিবুর রহমান হল’ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হলেও সেসব হলকে ব্যবহার উপযোগী করা হয়নি। 

সূত্র আরও জানায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ অনুযায়ী বিলুপ্ত কলেজের সব সম্পত্তির হিসাব পেতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মুসিহ মুহিত অডিট ফার্মকে। ফার্মটির অনুসন্ধানে তৎকালীন কলেজের ১২টি আবাসিক হল ছিলো বলে জানা যায়। এদের মধ্যে আরমানিটোলার এসি রায় রোডে আবদুর রহমান হলটি আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের। যদুনাথ বসাক লেনের সাইদুর রহমান হল ও টিপু সুলতান রোডের রউফ মজুমদার হল দুটির বর্তমানে কোনো অস্তিত্ব নেই।

আরমানিটোলার মাহুতটুলির ১ নম্বর শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোডের ৪০ কাঠা জমিতে শহীদ আনোয়ার শফিক হলটি দখলে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের। পাটুয়াটুলীর ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯ নম্বর জিএল পার্থ লেইনের ৮ দশমিক ৮৮৯ কাঠার উপর তিব্বত হলটি দখলে নিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ হাজী সেলিম। ২০০১ সালে হলটির নাম পরিবর্তন করে নিজ স্ত্রীর নামে ‘গুলশান আরা সিটি মার্কেট’ নির্মাণ করেন প্রভাবশালী এই নেতা।

পাটুয়াটুলীর ১৬ ও ১৭ নম্বর রমাকান্ত নন্দী লেনের শহীদ আজমল হোসেন হলে এক সময় থাকতো পুলিশ সদস্যের পরিবার। তাঁতী বাজারের ঝুলনবাড়ী লেনে শহীদ শাহাবুদ্দিন হল ছিলো পুলিশের দখলে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের জুনে এর দখল নেয় আওয়ামী লীগের নেতা আমিনুল হক। বংশালের ২৬ নম্বর মালিটোলায় বজলুর রহমান হলের ভবনে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পাটুয়াটুলীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ছয় তলা আবাসস্থল দখলে নিয়ে গড়ে উঠেছে ক্রাউন মার্কেট।

তবে এখনো কিছুসংখ্যক ছাত্র ও কর্মচারী বসবাস করে ৩৫ ও ৩৬ প্যারিদাস রোডের ১ নম্বর ঈশ্বরচন্দ্র দাস লেনে ১০ কাঠা জমির ওপর বাণী ভবনের কিছু অংশে।

জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হলে নজরে আসে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের। পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রণালয় দখল হওয়া ১২টি হল উদ্ধারের জন্য ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। সেই তদন্ত কমিটি ২০০৯ সালের মার্চ মাসে ৫টি হল বিশ্ববিদ্যালয়কে লিজ দেওয়ার সুপারিশ জানায়। সেগুলো হলো আজমল হোসেন, আনোয়ার শফিক হল, শাহাবুদ্দিন হল, তিব্বত হল ও হাবিবুর রহমান হল। আইনত সুবিধার্থে জেলা প্রশাসক ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি হলগুলো লিজের পরিবর্তে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বললেও মন্ত্রণালয় ও আইনি জটিলতায় থেমে যায় সেসব কার্যক্রম।

এ বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি কর্মকর্তা কামাল হোসেনকে ফোন দিলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবীর চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে আমার কাছে এখনো সম্পূর্ণ তথ্য নেই। যেটা রায় আছে কোর্ট থেকে আমাদের পক্ষে সেটা উদ্ধারের বিষয়ে কি করবো এ বিষয়ে আমাদের উদ্যোগ থাকবে। আমাদের হলগুলো উদ্ধারে আমরা আইনগতভাবে উদ্যোগ নেবো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র কয়েকদিন হলো। এখনো আমার কাছে এ বিষয়ে কেউ আসেনি। বিষয়গুলো নিয়ে আমি বিস্তারিত খোঁজ নেবো। আমার শিক্ষার্থীরা আবাসিকতাসহ নানা সংকটে আছে। শিক্ষার্থীদের এমন অমানবিক পরিস্থিতির জন্য আমি উপাচার্য হিসেবে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমি সেটার সুরাহা করার চেষ্টা করবো। অবশ্যই আমি দেখব।

/লিমন/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়