ঢাকা     রোববার   ০৭ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২৩ ১৪৩১

এক আলোকবর্তিকার নাম নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ

হযরত হানিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৬, ১৬ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৩:১১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৪
এক আলোকবর্তিকার নাম নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ

বেগম বাজারে অবস্থিত স্যার সলিমুল্লাহর মাজার।

বাঙালি মুসলিম সমাজের আলোকবর্তিকা হিসেবে যত অবিসংবাদিত নেতা এ অঞ্চলের মানুষের জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে আজীবন কাজ করে গেছেন, তাদের মধ্যে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর নাম অগ্রগণ্য । তিনি ১৮৭১ সালের ৭ জুন ঢাকার ঐতিহাসিক নবাব পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।

তাঁর পিতার নাম নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহ (১৮৪৬-১৯০১) এবং দাদার নাম নবাব খাজা আব্দুল গনি (১৮৩০-১৮৯৬)। পারিবারিক ঐতিহ্য, ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও প্রজাদের মাঝে জনপ্রিয়তার কারণে এই জমিদার বাড়ির খ্যাতি ছিলো সমগ্র বাংলায়।

ঢাকার জমিদার বাড়িতে বেড়ে উঠা স্যার সলিমুল্লাহ ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক তালিম ও গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ইংরেজি, জার্মান, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধাপে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সমগ্র ভারতেই জমিদারির ভীত ক্রমেই দূর্বল হয়ে উঠে। ফলে ১৮৯৩ সালে সরকারি চাকরি নিয়ে ময়মনসিংহে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন তিনি। পরে ১৮৯৫ সালে বিহারের মুজাফফরাবাদে এবং কিছুদিন ত্রিপুরায় দায়িত্ব পালন করেন।

১৯০১ সালের  ডিসেম্বরে পিতা নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে খাজা সলিমুল্লাহ পূর্ণাঙ্গভাবে ঢাকায় ফিরে আসেন। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে, সেবছরই পারিবারিক জমিদারি লাভ করেন। এর কিছুদিন পর ১৯০২ সালে সলিমুল্লাহকে ব্রিটিশ সরকার ‘কমান্ডার অব দ্য স্টার অব ইন্ডিয়া’ (সিএসআই) এবং ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি দিল্লির দরবার হলে সপ্তম অ্যাডওয়ার্ডের মুকুট পরিধানের রাজকীয় অনুষ্ঠানে ‘নবাব বাহাদুর’ উপাধিসহ  ১৯০৯ সালে কেসিএসআই এবং ১৯১১ সালে জিসিএসআই উপাধিতে ভূষিত হন।

ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজের  উন্নতি এবং পশ্চাৎপদ দরিদ্র কৃষক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে নওয়াব সলিমুল্লাহ বিভিন্ন যুগোপযোগী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম ব্রিটিশ সরকারের নিকট পূর্ব বাংলাকে স্বতন্ত্র প্রদেশ সৃষ্টির দাবি উপস্থাপন করেন। ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারি আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় নবাব সলিমুল্লাহর দেওয়া আসাম প্রদেশ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ এবং দার্জিলিং, জলপাইগুঁড়ি ও কুচবিহার জেলা নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবটি পেশ করেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ সৃষ্টি করে, ঢাকাকে এর রাজধানী ঘোষণা করা হয়।

তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করতে সমর্থ্য হয়েছিলেন যে, এই অঞ্চলের মানুষের জী্বন মান ও মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদের পেছনে অশিক্ষা সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে । ১৯০৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে নওয়াবের বাগানবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় ‘অল-ইন্ডিয়া মোহামেডান অ্যাডুকেশনাল কনফারেন্স’ এর ২০তম সভা। ওই সম্মেলন শেষে ৩০ ডিসেম্বর তাঁর প্রস্তাবে ঢাকায় গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’।

তিনি তার জীবদ্দশায় এ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে অকাতরে দান করে যান। তাঁর বাবার ইচ্ছানুয়ায়ী ঢাকার সার্ভে স্কুলকে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল হিসাবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যার প্রত্যয়ে তিনি খাস জমির পাশাপাশি প্রায় লক্ষ্যাধিক অর্থ ব্যায় করেন। তাঁর অনুদানে পরবর্তীকালে স্কুলটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষালয় হিসেবে প্রসার লাভ করে এবং তাঁর স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯০৮ সালে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় ‘আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল’। কালের পরিক্রমায় এটির নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়’ (বুয়েট)।

শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে জনহিতকর কাজেও নওয়াব সলিমুল্লাহের জুড়ি মেলা ভার। তিনি মুসলিম এতিম ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও বসবাসের জন্য ১৯০৮ সালে ঢাকার আজিমপুরে নিজের ২৮ বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা’। যা দেশের সর্ববৃহৎ ও অন্যতম পুরাতন এতিমখানা। তিনি এতিমখানায় ছেলে ও মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য আলাদা করে দুটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। শত শত এতিম ছেলেমেয়ের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহন করেছিলেন তিনি। শুধু ১৯০৫ সালে তার দানকৃত অর্থের পরিমাণ এক লাখ টাকার বেশি।

নবাব পরিবারের সদস্যরা (বামে) ও স্যার সলিমুল্লাহ।

১৯০৫ সালে নতুন প্রদেশ গঠনের সময় থেকেই নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অন্য প্রমুখ নেতারা পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। তবে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে এ দাবি শক্ত অবন্থান গ্রহণ করে।

১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে আসেন। সলিমুল্লাহসহ সহযোগী নেতারা হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আশ্বাস দেন, প্রদেশ বাতিলের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নওয়াব সলিমুল্লাহর দেয়া ৬০০ একর জমি এবং এর ভেতরের মনোরম ভবনগুলো নিয়ে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। তাঁর প্রতি সম্মানার্থে প্রতিষ্ঠাকালীন তিনটি আবাসিক হলের মধ্যে একটির ‘সলিমুল্লাহ মসলিম হল’ নামকরণ করা হয়।

রাজনৈতিকভাবে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে শত বছরের শোষিত অধিকার বঞ্চিত ভারতের মুসলমানদের জন্য ‘নিখিল ভারত মুসলম লীগ’ প্রতিষ্ঠা। যা ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্বের মাধ্যেমে দেশভাগ পর্যন্ত গড়ায়। তবে ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ায় নওয়াব সলিমুল্লাহ গভীরভাবে মর্মাহত হন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে হস্তান্তর করে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন।

নওয়াব সলিমুল্লাহ ও তাঁর পরিবার কেবল শিক্ষাবিস্তার ও সামাজিক কাজই করে যাননি। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারেও তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের পারিবারিক সংস্কৃতি ও প্রভাবকে বর্ণনা করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘স্যার ফিলিপ হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য’ গ্রন্থে উল্লেখ্য করেন, ‘নবাবেরা ছিলেন ধর্মভীরু। কিন্তু আধুনিক, সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক এবং হিন্দুদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। সেজন্য বড় বড় হিন্দু নেতা ও নগরের গোটা হিন্দু সম্প্রদায় নবাবদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন।’

ঢাকার নাগরিক জীবনে পঞ্চায়েত পদ্ধতিকে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও নওয়াব সলিমুল্লাহর অবদান অনস্বীকার্য। নাগরিক জীবনকে সহজ ও আনন্দময় করতে খেলাধূলা, গান-বাজনা, বায়োস্কোপ প্রদর্শনী, নাট্যাভিনয়সহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। নবাব পরিবারের হাত ধরেই ঢাকায় চলচ্চিত্রের বিকাশ। পুরান ঢাকার সংস্কৃতিতে এখনো নওয়াব পরিবারের অবদান পরিলক্ষিত হয়।

১৯১১ সালের পর থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। ‍তিনি ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার চোরঙ্গী রোডস্থ ৫৩ নম্বর বাড়িতে মাত্র মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। পরদিন ১৭ জানুয়ারি নবাব সলিমুল্লাহর মরদেহ ঢাকায় আনা হয় এবং পারিবারিক বেগম বাজার গোরস্তানে দাফন করা হয়।

নওয়াব খান বাহাদুর সলিমুল্লাহ পূর্ববাংলার আপামর জনসাধারণের কল্যাণে আজীবন কাজ করে গেছেন। আমরা তাঁর স্মৃতি ভুলতে বসেছি। আজ ১৬ জানুয়ারি তাঁর প্রয়াণ দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। এই জাতীয় ঐতিহাসিক দেশপ্রেমিকের কাছে আমরা ঋণী। আপনার মতো দেশপ্রেমিক গড়ে উঠুক প্রতিটি ঘরে।

(লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়