ঢাকা     রোববার   ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৭ ১৪৩১

বই হোক আমাদের সার্বক্ষণিক বন্ধু

ইমন ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  
বই হোক আমাদের সার্বক্ষণিক বন্ধু

যখনই বই পড়ার কথা আসে, তখনই চলে আসে প্রমথ চৌধুরীর কথা। তিনি তার বই পড়া প্রবন্ধে একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে গেছেন, ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত।’ বই পড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েই প্রবন্ধে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছিলেন। বিখ্যাত ব্যক্তিরাও জাতিকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করতে বলে গেছেন।

শিক্ষিত মানুষ মাত্রই স্বশিক্ষিত নয়। সমাজ, রাষ্ট্র বা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি জাতিকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করার বিকল্প নেই। স্বশিক্ষার জন্য পারিবারিক অনুশাসন জরুরি। ঠিক তেমনি প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন।

এ শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। যেহেতু একজন শিশুর মধ্যে ঘুমিয়ে আছে দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষক ও রূপকার। তাই শিশুকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তুলতে হবে। আর তা সম্ভব পাঠ্যপুস্তক পাঠের পাশাপাশি তাকে অন্যান্য বই পাঠেও আগ্রহী করে তোলার মাধ্যমে।

এ জন্য শিশুর মনে একটা প্রশ্ন জাগিয়ে রাখতে হবে। তা হলো ‘কী’ এবং ‘কেন’-এর দ্বারা তার মধ্যে জানার আগ্রহ জাগিয়ে রাখতে হবে। অর্থাৎ তার মধ্যে জ্ঞানের তৃষ্ণা জাগিয়ে তুলতে হবে।

বই পড়লে শিশুরা আনন্দ পায়, তাদের কল্পনাশক্তি বাড়ে। বই পাঠ শিশুদের নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা বাড়ায়। সেই সঙ্গে মনোযোগ ও যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। শিশুদের সামগ্রিক বিকাশে বই পড়ার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।

আমাদের হৃদয়ের অন্তরতম বন্ধু বই। মানুষের মধ্যে নতুন নতুন চিন্তা চেতনার বিকাশ, মানুষের মনে জমে থাকা গ্লানি ও বিষাদময় সময় পুরোপুরি ভাবে বিসর্জন দিয়ে মনকে তরতাজা রাখতে বই একটি অদ্বিতীয় সম্পদ। বই মানুষের এমন এক বন্ধু যা সমস্ত ভালো ও মন্দ মুহূর্তগুলোকে অভিযোজন করবার ক্ষমতা তৈরি করে দেয় ব্যক্তির মধ্যে। মানুষকে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে।

দেশের জনসংখ্যার পাশাপাশি বাড়ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা। কিন্তু কমছে বই প্রীতির সংখ্যা। প্রযুক্তির বর্ধমান অগ্রগতির সঙ্গে মানুষের চিন্তা জগতের যেভাবে পরিবর্তন ঘটছে, সেই হারে আমাদের বইপড়ুয়া প্রজন্ম গড়ার প্রচেষ্টা খুবই হতাশাজনক। শিশু-কিশোর, যুবক-তরুণ প্রজন্মের মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব প্রীতির খেসারত দিচ্ছে আজ জাতি। প্রতিটি পরিবারে মানবিক বোধহীন, দেশপ্রেমের চেতনাহীন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে আদর্শ-উদ্দেশ্যহীন ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ কারণে সমাজে অস্থিরতা, খুন, মাদকতা, ধর্ষণ, ছিনতাই, অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এই অবস্থার পরিত্রাণ সম্ভব একমাত্র বইপড়ুয়া প্রজন্ম গড়ার মাধ্যমে।

তথ্যপ্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক বিকাশের ফলে বর্তমানে Book এবং Facebook এর ব্যবহারিক দিকটি সবচেয়ে বেশি আলোচ্য বিষয়। যেহেতু ফেইসবুকের উপস্থাপনা বা প্রেজেন্টেশন ব্যবহারকারীর নিকট অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং ফেইসবুকের কনটেন্ট অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। তাই মানুষ বইয়ের চেয়ে ফেইসবুক ব্যবহারে অনেক বেশি আগ্রহী। তাছাড়া ফেইসবুক পড়ার বা দেখার জন্য ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোও ফেইসবুকের লেখা, ছবি বা ভিডিওকে অনেক আকর্ষণীয়ভাবে ব্যবহারকারীদের সামনে উপস্থাপন করে।

দেশের মোটামুটি সব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হওয়ায় একজন ব্যবহারকারী সহজেই ফেইসবুকে ঢুকতে পারেন। ফলে বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় বইয়ের চেয়ে ফেসবুক অনেক বেশি সহজলভ্য এবং জনপ্রিয়। সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে যাদের বইয়ে নিমগ্ন থাকার কথা সেসব শিক্ষার্থীরাও বইয়ের পাতা না উল্টিয়ে ফেইসবুক নিয়ে অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকেন।

একটি জাতির মেধা ও মননের আঁতুড়ঘর হলো তার বইয়ের জগৎ বা লাইব্রেরি। একই সঙ্গে দেশের সব মেধার সংগ্রহশালাও হল এই লাইব্রেরি। সময়ের প্রয়োজনে এই সংগ্রহশালাকে মেলার মধ্য দিয়ে প্রদর্শন ও প্রচার করা হয়ে থাকে। এতে এই বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডার চলে আসে সবার হাতের নাগালে। বিশাল জ্ঞান-সমুদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার একটি বড় সুযোগ তৈরি হয়। যে জাতির বই-পুস্তক সংখ্যা যত বেশি তার মেধাগত সমৃদ্ধিও তত বেশি। 

বইমেলায় সাহিত্যের সব ভাণ্ডার একেবারে হাতের নাগালে পাওয়া যায়। এতে করে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়ার বাইরে অন্য বই সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ পায়। তাদের চিন্তায় জ্ঞানের নতুন তৃষ্ণার জন্ম হয়। ক্রমে তারা মেতে উঠতে পারে জ্ঞান-সমুদ্রের সীমাহীন জ্ঞানাহরণে। ফলে একটি জ্ঞানী, সুশিক্ষিত ও মেধাসম্পন্ন জাতি তৈরি হওয়ার পথ সুগম হয়।

একমাত্র বইয়ের মধ্যেই আছে সব ধরনের জ্ঞান। তাই জীবনের জন্য বই প্রয়োজন। প্রত্যেকের জীবনেই একঘেয়েমি, দুঃখ-কষ্ট, অস্থিরতা, মানসিক সমস্যাসহ নানা সমস্যা রয়েছে। কিন্তু বই পড়লে সেসব চিন্তা মাথায় থাকে না। অবসরের সময়গুলো বিনোদনের মাধ্যমে কাটানোর জন্য কত কিছুই না আবিষ্কৃত হয়েছে এই পৃথিবীতে। কিন্তু বই পড়ার মতো নির্মল আনন্দের সমতুল্য হতে পারেনি সেসব ।

আমরা সবসময় বন্ধু খুঁজে বেড়াই। কিন্তু আমরা আমাদের প্রকৃত বন্ধুটিকেই খেয়াল করি না। বই হলো মানুষের জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট বন্ধু। আমাদের মানব বন্ধু ধোঁকা দিলেও বই কখনও ধোঁকা দেয় না। বরং সে আমাদের উপহার দেয় একটি সুন্দর জীবন। বই মানুষকে আলো দেয়। যে আলোয় আলোকিত হয়ে জীবন সাজায় মানুষ। শিক্ষার আলো, নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সবকিছুই রয়েছে বইয়ের মধ্যে। মানুষ বই পড়ে তার চাহিদাগুলো পূরণ করে থাকে।

বই পড়লে মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়। জনাথন সুইফট বলেছেন, ‘বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান’। বই পড়লে মস্তিষ্কের জটিল কোষগুলো উদ্দীপিত হয় এবং স্নায়ুগুলো উজ্জীবিত হতে থাকে। পড়ার সময় পাঠকের মস্তিষ্ক ভিন্ন জগতে বিচরণ করে এবং পঠিতব্য বিষয়ের প্রতি সে মনোনিবেশ করতে পারে। এভাবে বইয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নানাবিধ বিচরণের কারণে পাঠকের মানসিক চর্চা বৃদ্ধি পায়।

একজন মানুষ যে পেশায়ই দক্ষ হোক না কেন, তার পেশাদারিত্বে উৎকর্ষতা সাধনের জন্য বইয়ের কাছেই তাকে বারবার ফিরে আসতে হয়। কারণ জ্ঞানের সূচনা সেখান থেকে এবং সে জ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানোর দক্ষতা মানুষ বই পড়েই অর্জন করে থাকে। মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তার যাবতীয় সূচনার বিস্ফোরণ একমাত্র বইয়ের মাধ্যমেই সম্ভব । আর সেই বইয়ের বিপুল যোগান দিতে বইমেলা কিংবা গ্রন্থাগারের কোনো বিকল্প নেই। 

সুতরাং যতই বইয়ের লিখন, প্রকাশন ও বিপণন বাড়বে ততই আলোর রাজ্যেরও বৃদ্ধি ঘটবে। এ জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে বই পড়তে হবে। বই পড়তে হলে কিনতে হবে। কিন্তু বাঙালিদের বই কেনার প্রতি বড়ই অনীহা, বই ধার দিতে চাইলেও পড়তে চায় না, যেন বই পড়ার সময় নেই তাদের।

তবে অকাজে সময় ব্যয় করতে পারদর্শী। বিদ্যাচর্চার চেয়ে অর্থচর্চায় বেশি মনোযোগী। বই না পড়ার ফলে অপসংস্কৃতি, অমার্জিত লোকজনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আর কমে যাচ্ছে রুচিশীল, সংবেদনশীল, হৃদয়বান মানুষ। তরুণরা ঝুঁকে পড়ছে জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন খারাপ কাজের প্রতি, যা উন্নত রাষ্ট্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরাট হুমকি।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
 

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়