ঢাকা     রোববার   ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৭ ১৪৩১

উচ্চশিক্ষায় উপেক্ষিত বাংলা ভাষা

তাওহিদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৪, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  
উচ্চশিক্ষায় উপেক্ষিত বাংলা ভাষা

‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশীয় ভাষা, পুরে কি আশা?’- রামনিধি গুপ্তের এ কথাটি আমরা ভাব-সম্প্রসারণ আকারে বহুবার পড়েছি। নিজ মাতৃভাষায় নিজের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশে যে আনন্দ, যে ভালোলাগা কাজ করে, সেটি পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার বেলায় কাজ করে না। নিজ মাতৃভাষায় চিন্তার, বিবেকের আত্মপ্রকাশ যত সহজে ঘটানো, যায় পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় সেটি যায় না।

মাতৃভাষা যেমন সুর, সাহিত্য, ভালোবাসায় মোড়ানো মহাকাব্য, ঠিক তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বর্জ্যধ্বনি হয়ে ওঠার অমোঘ হাতিয়ার। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানীরা তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। কারণ তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল, মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমে একটি জাতির অধিকার হরণ করা যায়, বিকাশ ও সমৃদ্ধির পথকে রূদ্ধ করা যায়, শিল্প-সাহিত্য ও ইতিহাসকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা যায়।

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের এ অন্যায় আবদারের সঙ্গে আপোষ না করে তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। নিজ মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবীতে তমুদ্দীন মজলিস ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের জারি করা ১৪৪ ধারা এবং বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা আরও দুই লক্ষ প্রাণ মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আত্মদান করে। ভাষা শহীদদের রক্তকে ভয় করে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা ১৯৫৪ সালে গণপরিষদে এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা মাধ্যমে  শিক্ষণ পদ্ধতি নিশ্চিত করতে পারিনি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা ভাষায় লেখা বই এবং বাংলা ভাষায় পাঠদান করা হলেও উচ্চশিক্ষায় বিশেষ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান ও শিক্ষণে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি।

দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগে পুরোদমে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হচ্ছে। বিজ্ঞান ও ব্যবসায় অনুষদের বিষয়ভিত্তিক বইগুলো ইংরেজিতে লেখা। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ণ ইংরেজি মাধ্যমে হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা নানা বিড়ম্বনা পড়ছে। কলা অনুষদে কিছু বিষয় বাংলা মাধ্যমে পড়ানো হলেও সামাজিক বিজ্ঞান ও আইন অনুষদে ঠিকই শিক্ষার্থীদের উপর ইংরেজির খড়গ চাপানো হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। সেখানে প্রায় শতভাগ ইংরেজি পাঠক্রমে পড়ানো হয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চাকরির বাজারে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের টিকিয়ে রাখার জন্য এবং বেশি করিতকর্মা হিসেবে উপস্থাপনের জন্য ইংরেজিতে পাঠগ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে। অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, প্রেজেন্টেশন, পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ সর্বত্র ইংরেজি ভাষার প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা না বললে মহাভারত অশুদ্ধের মতো অপরাধ করেছে বলে পরিগণিত করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ নামে একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সেটি বাংলা ভাষায় পাঠদান এবং উত্তরপত্রে শিক্ষার্থীদের বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই বিষয়টিও ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে উত্তর লিখতে বাধ্য করা হচ্ছে। 

দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাভাষা ব্যবহারের এই উপেক্ষা শুধু প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকদের নয়। এ দায় রাষ্ট্রের, সরকারের। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। অভিন্ন ভাষা পদ্ধতি (বাংলা ভাষা) প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এক সুতার বন্ধনে বাঁধার কথা বলছেন।

তিনি বলেছেন, ইংরেজিতে লেখা বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করার জন্য অনুবাদক দেশে অপ্রতুল। দেশে ভালো অনুবাদক তৈরি করা, শিক্ষায় বাংলা ভাষা ব্যাপক হারে প্রচলন, প্রসারণের জন্য আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। অথচ আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে নির্বিকার ও নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছেন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ৫২-এর ভাষা আন্দোলন। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছরে পদার্পণ করার পথে থাকলেও আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষা উপেক্ষিত।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিলেও দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিদের বাংলা ভাষা বিমুখ করা হচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল সংবিধান ব্যাখ্যায় ১৫৩ অনুচ্ছেদবলে বাংলা ভাষা প্রাধান্য পাবে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলা ভাষায় পাঠদান উপেক্ষা করছে। ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ করা হলেও কৌশলে সেই আইনে স্পষ্ট করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা উহ্য করে রাখা হয়েছে। অথচ সেটিই আগে উল্লেখ করা দরকার ছিল। চাকরি ক্ষেত্রে তো আরও ভয়াবহ অবস্থা। কোনো চাকরি প্রার্থীর যদি ইংরেজিতে ভালো দখল না থাকে, তাহলে তার চাকরিই হবে না।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ।’ রবীন্দ্রনাথের এই কথা আমরা না বুঝলেও বুঝতে পেরেছে আমাদের শাসন করা ব্রিটিশরা, বুঝতে পেরেছে বর্তমান বিশ্ব শাসন করা আমেরিকা, চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মান, ফরাসিরা। উন্নত বিশ্বের প্রায় সবগুলো রাষ্ট্র নিজ মাতৃভাষায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমনকি স্নাতকোত্তর পর্যায়েও মাতৃভাষায় পাঠদান পদ্ধতির প্রচলন অক্ষুণ্ণ রেখেছে। তত্ত্বীয় ও পদ্ধতিগত নানা বিষয় এবং বই বিভিন্ন ভাষায় লেখা থাকলেও নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের সহজবোধ্যভাবে বোধগম্য করার জন্য অনুবাদক দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নিয়েছে। নিজ মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে তাদের শেখা এবং জানাকে টেকসইভাবে রূপান্তর করে টেকসই জাতি নির্মাণে অগ্রসর হচ্ছে। আমরাও আমাদের জাতিকে টেকসইভাবে গড়ার জন্য উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার নিরঙ্কুশ প্রচলনের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপে গ্রহণ করতে পারি-

১. ইংরেজি বইগুলো বাংলায় সহজবোধ্য এবং মান অক্ষুণ্ণ রেখে অনুবাদ করতে পারি।
২.দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষা শিক্ষাস্থান (ইনস্টিটিউট) স্থাপন করতে পারি এবং সেখানে বাংলা ভাষার মানোন্নয়ন ও নির্ভূল অনুবাদ নিয়ে গবেষণা করতে পারি।
৩. বাংলা একাডেমিকে সব ধরনের স্বার্থ এবং রাজনীতির উর্ধ্বে রেখে স্বাধীনভাবে দেশের নেতৃত্বস্থানীয় বাংলা ভাষা গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তর করতে পারি।
৪. আর্থিক প্রণোদনা এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে অনুবাদক এবং ভাষাবিদদের সহযোগিতা করতে পারি।
৫. উন্নত বিশ্ব যেমন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রচলন করে তাদের ভাষাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরছে। আমরাও আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমাদের বাংলা ভাষাকে সার্বজনীন করে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারি।

ভাষার মাসে আমাদের নতুন শপথ হোক উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ভাষায় পাঠদান এবং শিক্ষণ নিশ্চিত করা।  রবী ঠাকুরের ভাষায়, ‘দূরদেশী ভাষার থেকে আমরা বাতির আলো সংগ্রহ করতে পারি মাত্র, কিন্তু আত্মপ্রকাশের জন্য প্রভাত-আলোক বিকীর্ণ হয় আপন ভাষায়।’ আমরাও আমাদের প্রভাত-আলোক বিকীর্ণ করি আপন ভাষায়। আমাদের মায়ের ভাষায়। রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের বাংলা ভাষায়। শুধু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে সমস্বরে বলি- ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।’

(লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগে, চতুর্থ বর্ষ, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়।)


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়