ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

ধর্ষণের বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে উত্তাল জাবি

জাবি সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:১৭, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ২০:৪৫, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ধর্ষণের বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে উত্তাল জাবি

সম্প্রতি আবাসিক হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, হল থেকে অবৈধ শিক্ষার্থীদের উচ্ছেদসহ নানা দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)। বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সংগঠন।

সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার সংলগ্ন রাস্তায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে জাবির রেজিস্ট্রার্ড গ্রাজুয়েট সিনেট প্রতিনিধিবৃন্দ।

এসময় জাবির সাবেক উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির বলেন, আমরা আজ এখানে ধর্ষণ ও গণরুমের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করতে এসেছি। আমরা চাই যারা ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের ফাঁসি দেওয়া হোক। হলে ২৫০০ নয়, খুঁজে দেখেন পাঁচ হাজার ছাত্র অবস্থান করছে। অছাত্ররা হলে অবস্থান করে আর বৈধ শিক্ষার্থীরা মানবেতর জীবন যাপন করে। অবিলম্বে হল থেকে গণরুম উচ্ছেদ করতে হবে।

তিনি বলেন, হলের প্রাধ্যক্ষ ও ওয়ার্ডেনদের হলে থাকতে হবে। ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। রাতে নির্দিষ্ট সময়ে যেন ছেলে মেয়েরা ফিরে আসে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। হলের পাশে থাকা দোকান উচ্ছেদ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কেনো দোকানের টাকায় চলবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অটোরিকশা বন্ধ করতে হবে। 

উপাচার্যকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন,  আপনি আমাদের (সিনেটর) ভোটে নির্বাচিত উপাচার্য। আপনি কেনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ভয় পান। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আপনি মনে রাখবেন পাঁচদিন মানে পাঁচ। এরপরে যেন একজন অছাত্র, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, বহিরাগত যেন  আবাসিক হলে স্থান না পায়। ২১টা হলের প্রাধ্যক্ষ এক সঙ্গে যদি তাদের হলে অভিযান পরিচালনা করেন, তাহলে কোনো অবৈধ শিক্ষার্থীর সাহস নেই সামনে দাঁড়ানোর।

সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, সারা পৃথিবী জুড়ে যে নিন্দার বহর বইছে, সেটা বন্ধ করতে চাই। এজন্য আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি জানি কিভাবে ছেলেমেয়েদেরকে আদর সোহাগের মধ্যেমেও শাসনে রাখতে হয়। কিন্তু আপনারা শুধু আদর দিয়ে রাখবেন, সেটা আমরা চাই না। এই নিপীড়নদের পক্ষে যারা দাঁড়িয়েছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। 

আশীশ কুমার মজুমদার বলেন, আমরা সব সময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে তাই অবিলম্বে বিচার সম্পন্ন করতে হবে। হলে অছাত্ররা অবস্থান করছে, আর বৈধ শিক্ষার্থীরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। আমরা দেখতে চাই পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে অবৈধ ছাত্ররা হল ছেড়ে দিয়েছে।

ড. শামসুল আলম সেলিম বলেন, সংগঠের নাম ভাঙ্গিয়ে যারা অপকর্ম করে তাদের বিতাড়িত হতে হবে। আমরা চাই নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের দাবিগুলো বাস্তবায়ন হোক। আমরা উপাচার্যকে বলতে চাই সব দায় আপনার উপরেই বর্তাবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হতে হবে। একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও তার ব্যাপারে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তাকে কিন্তু এখনো বহিষ্কার করা হয়নি। সিন্ডিকেটে যে দাবিগুলো তোলা হয়েছে প্রশাসনকে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের অনুরোধ জানাচ্ছি।

নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের বিক্ষোভ

দুপুর দেড়টায় নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের ব্যানারে ধর্ষণ ও নিপীড়নমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

এসময় বক্তারা চার দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবি গুলো হলো- ধর্ষক ও তার সহায়তাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে গণরুম বিলুপ্তপূর্বক নিয়মিত শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিত করতে হবে, নিপীড়ক শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনির বিচার নিষ্পত্তিসহ ক্যাম্পাসে নানাবিধ অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং নিপীড়কদের সহায়তাকারী প্রক্টর ও হল প্রভোস্টের অপরাধ তদন্তপূর্বক তাদেরকে প্রশাসনিক পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে হবে।

এসময় নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, ১৯৯৮ সালে আমরা যখন জাহাঙ্গীরনগরে ছিলাম, তখন ধর্ষণের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন আন্দোলন গড়ে উঠেছে। সেদিন জাবিতে যখন ধর্ষণের ঘটনা শুনে আমার হৃদয় কেঁদে উঠেছে। এই ঘটনা কেন তদন্ত সেলের কাছে আসেনি আমাদের প্রশ্ন। আমি প্রশাসনকে বলবো যদি সহযোগিতা চান, আমাদের অভিজ্ঞতা আপনাদের কাজে লাগবে।

সমাবেশে অন্যদের মাঝে বক্তব্য দেন, নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের সদস্য সচিব মাহফুজ ইসলাম মেঘ, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রব্বানি, অধ্যাপক পারভীন জলি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া।

এসময় অধ্যাপক সোহেল আহমেদ, অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার ও বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। 

ধর্ষণের বিচার ও নিপীড়নমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি

বিকেল ৩টার দিকে ধর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার ও নিপীড়নমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বর থেকে মিছিল শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে শেষ হয়। 

এসময় শিক্ষার্থীদের 'আমাদের ক্যাম্পাসে ধর্ষকের ঠাঁই নাই, ধর্ষক মুক্ত ক্যাম্পাস চাই, নিরাপদ ক্যাম্পাস দাও, ধর্ষকদের কোন দল নেই- একথা বলবেন না' প্রভৃতি স্লোগান দিতে দেখা যায়। 

বিক্ষোভ মিছিল শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার ও নিপীড়নমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি জানান৷ 

এসময় বক্তব্য দেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী আশফার রহমান নবীন, নৃবিজ্ঞান ৫২ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফারাবী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী তাহসিন তৌসিফ, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলি প্রমুখ।

পাঁচ দফা দাবি সাংস্কৃতিক জোটের

বিকাল সাড়ে ৪টায় শহিদ মিনার পাদদেশে ধর্ষণ ও নিপীড়নমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাসসহ পাঁচ দফা দাবিতে মানববন্ধন করেছে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট।

এসময় যৌন নিপীড়ন সেলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জোটের সভাপতি শরণ এহসান পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো- ধর্ষণের সুষ্ঠু সুরাহা করতে হবে এবং যারা পালাতে সাহয্য করছে তাদের বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। হলে ক্ষমতাসীনদের গণরুম কালচার বিলুপ্ত করে অছাত্রদের হল থেকে বের করতে হবে। দলীয় রাজনীতি প্রভাব কমাতে হবে। দলের নাম ভেঙ্গে যারা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস করে প্রভাব বিস্তার করে তাদের বিরুদ্ধে এবং ক্যাম্পাসে নিরাপদ পরিবেশের জন্য প্রশাসনকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

ফাইজা মেহজাবিন প্রিয়ন্তীর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য দেন, জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের নাট্যকর্মী মিথিলা, সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি সাদ্দাম হোসেন রোহান, সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া জাহান,প্রমুখ।

উল্লেখ্য, গত শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে  ৯টার দিকে জাবির মীর মশাররফ আবাসিক হলের ৩১৭ নং কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে কৌশলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ও মামুনুর রশীদ মামুন।

/আহসান/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ