জাবিতে ধর্ষণ
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ভোররাতে হল থেকে পালান শাহ পরান
আহসান হাবীব, জাবি সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ক্যাম্পাসে ডেকে এনে বহিরাগত এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের পলায়নে সহায়তা করার নির্দেশদাতা শাহ পরান রাতের পুরোটা সময়ই মীর মশাররফ হলের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন। কিচেনের তালা ভেঙে পলায়নে সহায়তাকারীদের শিক্ষার্থীর দাবির মুখে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলেও, নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী শাহ পরান ছিলেন সবার লোকচক্ষুর আড়ালে। পরে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভোররাতে হল থেকে পালান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) রাতের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনার দিন ভোররাত ৪টা ৫৬ মিনিটে শাহ পরান মীর মোশাররফ হোসেন হলের দ্বিতীয় তলার ২১০/২১১ নং কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। এ সময় শুধু চোখখোলা অবস্থায় তার নাক-মুখ ছিল মাফলারে পেঁচানো। মাথা নিচু করে দ্রুতগতিতে তাকে দ্বিতীয় তলার এ-ব্লকের পূর্ব পাশের সিঁড়ি ব্যবহার করে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।
সিসিটিভি ফুটেজ অনুসারে, প্রভোস্ট ও প্রক্টোরিয়াল টিমের সদস্যরা ভোররাত ৪টা ১২ মিনিটে এ-ব্লকের ২১০ ও ২১১ নং কক্ষে তল্লাশি চালান। তবে, সে সময় ২১১ নং কক্ষটি ছিল বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। তালাবদ্ধ থাকায় তল্লাশি করতে আসা শিক্ষক ও অন্যান্যরা চলে যান। ২১০ নং কক্ষটিতে এ সময় ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতারা অবস্থান করছিলেন।
তবে, ওই রাতের (শনিবার) ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, দিবাগত রাত ১টা ১৭ মিনিটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পলায়নে সহায়তা করা সাগর সিদ্দিকী, সাব্বির হোসেন সাগর ও হাসানুজ্জামানকে গেস্টরুমে আটক করেন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ও প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা। এ সময় তারা পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা হিসেবে সহ সভাপতি শাহ পরানের নাম বলেন। তখনই হঠাৎ করে গা-ঢাকা দেন শাহ পরান। তবে, বাইরে থেকে হলের মেইন গেইট বন্ধ থাকায় নিশ্চিতভাবেই তিনি হলে অবস্থান করছিলেন। এ সময় আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান ও দেলোয়ার হোসেন এসে প্রক্টরকে জানান, তারা শাহ পরানের অবস্থান জানেন। আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান এ সময় শাহ পরানকে নিয়ে আসার দায়িত্ব নেন। তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে প্রক্টর ও প্রভোস্ট তাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২১০ নং কক্ষটি শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি প্রীতম আরিফের। ২১১ নং কক্ষে অপর সহ সভাপতি বিপ্লব হোসাইন দীর্ঘদিন ধরে থাকেন। তবে, ঘটনার দিন বিপ্লব হলের ভেতরে ছিলেন না বলে দাবি করেছেন তিনি। তবে, বিপ্লবের কক্ষের একটি চাবি প্রীতমের কাছে ছিল। সে সময় তিনি শাহ পরানকে ২১১ নং কক্ষে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেন বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী নিশ্চিত করেছেন। প্রীতম আরিফ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান ও বিপ্লব হোসাইনের সহায়তায়-ই হলের কক্ষে লুকিয়ে থাকেন শাহ পরান।
প্রীতম আরিফ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান ও বিপ্লব হোসাইন প্রত্যেকেই শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সহ সভাপতি পদে রয়েছেন। হল ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা ও সর্বোচ্চ ব্যাচের শিক্ষার্থী হওয়ায় তারা পলিটিকাল ব্লকের মাঝের কক্ষগুলোতে অবস্থান করেন। হল ছাত্রলীগের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী, সর্বোচ্চ সিনিয়র নেতারাই মেইন গেইটের উপরস্থ এ দুটি কক্ষে অবস্থান করার অধিকার পান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি প্রীতম আরিফ বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নেই, হলেও নিয়মিত থাকি না। আমার বাবা-মা অসুস্থ। সেদিন হলে গিয়েছিলাম দুই তলা থেকে তিন তলায় রুম শিফট করার জন্য। রাতে শাহ পরান তো একা আমার রুমে আসেনি। ৪৪ ব্যাচের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, দেলোয়ার, আজাদ, শাহ পরান, ইমরান, ফরিদ— এরা সবাই আমার রুমে এসেছিল। ওখানে যখন শাহ পরানের কথা উঠেছে, তখন সে রুম থেকে বের হয়ে গেছে। এরপর তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পৃক্ততা নেই, আমি কিছু জানিও না। সাথে সাথেই প্রভোস্ট স্যার, সাংবাদিক সবাই আমার রুমে আসেন। তখন পর্যন্ত সে ছিল আমার রুমে, কিন্তু তার নাম আসেনি। যখন তার নাম আসল, তখন সে রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়। আমি তাকে কোনভাবে পালাতে সহায়তা করিনি। আমরা তো সোহেল ভাইয়ের রাজনীতি করতাম, হলেও তো একটা ইন্টার্নাল গ্রুপিং আছে। সেটার জন্য হয়তো-বা কাঁদা ছোড়াছুড়ি বা আমার নাম ইনক্লুড করা হয়েছে।’
শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান বলেন, ‘শাহ পরানের নামে অভিযোগ উঠলে প্রক্টর স্যার ও সাব্বির স্যার আমাকে ফোন করে শাহ পরান কোথায় আছে, তাকে খুঁজে নিয়ে আসতে বলেন। তখন আমি পরানের রুমে তাকে খুঁজতে যাই, কিন্তু সে রুমে ছিল না। যে রুমগুলোতে পরানের যাতায়াত ছিল, সেখানে আমি খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। আমি প্রভোস্ট এবং প্রক্টর স্যারকে গিয়ে রিপোর্ট করি, তাকে খুঁজে পাইনি। আমি পরানকে পালাতে সাহায্য করেছি কেউ যদি এটা বলে থাকে, তাহলে সে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বলেছে। ভোর চারটার পরে প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা আমিসহ আমার সব বন্ধু ও ছাত্রলীগকর্মীরা মিলে তাকে খোঁজাখুঁজি করেছি।’
শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি বিপ্লব হোসেন বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ দেখলে দেখবেন, আমি সারারাত হলের বাইরে ছিলাম। হলের ভেতরে আমি না ঢুকলে কেউ ঢুকবে কী করে? কারণ চাবি ছিল আমার কাছে। ২১১ নম্বর রুম। ৬টার আগে হল থেকে বের হয়েছি, মানে দুপুরের আগে। দুটো ছোট ভাইসহ এক জায়গায় গিয়েছিলাম, ওখান থেকে আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে গেছে। পরে এসে দেখি এরকম ঘটনা। তারপর বটতলা গিয়েছি এবং সেখান থেকে ৬টার দিক আসছিলাম আর হলে ঢুকিনি। যদি এ সময় আমার কোনও মুভমেন্ট পান, তাহলে নিউজ করেন। আমি শিউর, আপনি পাবেন না।’
অবশ্য মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক সাব্বির আলম একাধিকবার নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে মিলে একাধিকবার হলের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজে এসেছি। কতগুলো রুম তালাবদ্ধ ছিল। সেগুলোও লাইট মেরে, জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। আমার সাথে আন্দোলনকারীরা ছিল, সাংবাদিকরা ছিল। কোথাও শাহ পরানকে পাইনি। ছাত্রলীগের ওদের দায়িত্ব দিলেও আমি তো বসে ছিলাম না। আমি নিজেও রনি স্যারসহ ভালোভাবে খুঁজেছি। আমরা বুঝতে পারছিলাম, সে হলে আছে। তবে খুঁজে পাইনি।’
উল্লেখ্য, গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ আবাসিক হলের ৩১৭ নং কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে কৌশলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন আসামি মোস্তাফিজ ও মামুনুর রশীদ মামুন।
পড়ুন
মোস্তাফিজকে হলে আশ্রয় দেন জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি, সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব
ছাত্রলীগ নেতাসহ ৪ জনের ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন
সাব্বির/এনএইচ