ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

তাসনিমুল হাসান প্রান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৫, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমোচ্চারিত হচ্ছে ভালোবাসার অমীয় বাণী। এরকম সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি সচরাচর ক্রোধ-সংঘাতের পৃথিবীতে দেখা যায় না। অস্ত্র, হানাহানি মারামারি ছেড়ে গোটা দেশে আজ যোগ দিয়েছে ফু‌লের শুভেচ্ছায়। ভালোবাসায় মেতে উঠেছে সবাই।

ভালবাসা দিবস শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভালোবাসা সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের, বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা অথবা বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা। কিংবা অসহায়-দুঃস্থ মানুষদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা। দেশের প্রতি নাগরিকদের ভালবাসা। প্রত‌্যাশা, প্রতি‌দিনই হোক ভালোবাসা দিবস।

ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হয় আধুনিক ভ্যালেন্টাইন ডে রীতি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের একটি নাম ভ্যালেনটাইনেস ডে। তরুণ-তরুণীরা মনের মানুষের কাছে চিঠি, এসএমএস, ভিডিও বার্তায় ভালোবাসার নিমন্ত্রণ পাঠায়। ১৯৩৬ সালের পূর্বে কাগজের কার্ডের পরিবর্তে তামার পাত বা কাঠের ফলকে খোদাই করে মনের কথা পাঠানো হতো। ইউরোপে ১৪ ফেব্রুয়ারি আসার এক সপ্তাহ পূর্ব থেকেই উৎসব শুরু হয়ে যায়।

পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এ দিবস ঘটা করেই পালন করা হয়। শিশুরা স্কুলে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ সঙ্গীত পরিবেশন করে। বিশেষ খাবারের আয়োজন করে ইতালির অধিবাসীরা। আর কাগজের তৈরি লাল ফুল বিনিময় করে ডেনমার্কবাসী। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। রয়েছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উদযাপন পরিষদ, ‘যৌতুক নয় ভালোবাসায় জীবন গড়ি’ স্লোগান নিয়ে ১৯৯৮ সালে এ দেশে তাদের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

গত কয়েক বছর ধরে অনেক মুসলিম দেশে এই দিবস পালনের রীতি চালু হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হোক বা না হোক, দিবস পালনের নিষেধাজ্ঞা চোখে পড়ে না। বরং কিছু মিডিয়া এমনভাবে অনুষ্ঠান প্রচার ও লেখালেখি করে, যাতে অর্ধ-মৃত মানুষেরও ঘুম ভেঙে যায় দিবসটি পালনের তাড়নায়। কারো কারো কাছে এ দিবস যেন অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। তারা নানাভাবে উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

দিবসটি শুরুর ইতিহাস  হিসেবে একাধিক ঘটনা জানা যায়। কোনটি সঠিক বলা মুশকিল। প্রত্যেকেই তার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রাচীন রোমবাসী কুমারী মেয়েরা ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনে ভালোবাসার কাব্য লিখে মাটির পাত্রে জমা করত, আর যুবকরা পাত্র থেকে একটি লেখা তুলে নিতো। যুবকের হাতে যার লেখা উঠে আসতো, সেই মেয়েকেই সে পরবর্তী এক বছরের জন্য সঙ্গী হিসাবে নির্বাচন করতো।

অপর একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ হওয়ার পর ধর্ম প্রচারের অভিযোগে ইতালির সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক একজন চিকিৎসক খ্রিস্টান পাদ্রিকে তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস বন্দি করেন। বন্দি অবস্থায় কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলায় তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েটির সঙ্গে ভ্যালেন্টাইন ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কারাবন্দি অবস্থায় তিনি ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়লে রাজা তাকে ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড দেন। এরপর থেকেই খ্রিস্টান সম্প্রদায় ভ্যালেন্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে এ দিবসটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করতে থাকে।

ভ্যালেন্টাইন্স দিবসের মতো খ্রিস্টানরা আরও অনেক দিবস পালন করে থাকে। যেমন- সেন্ট এন্ডু ডে (৩০ নভেম্বর), সেন্ট মার্টিন ডে (১১ নভেম্বর), সেন্ট বার্থেলোমিজম ডে (২৪ আগস্ট), সেন্ট জর্জ ডে (২৩ এপ্রিল), সেন্ট পথাট্রিক ডে (১৭ মার্চ)। কিন্তু উৎসবের প্রকাশভঙ্গি গির্জার চেতনাবিরোধী হয়ে পড়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ হয়।

আজকাল ১৪ ফেব্রুয়ারি এলেই এক শ্রেণীর প্রেমিক-প্রেমিকা একে-অপরকে একান্তে পাওয়ার ইচ্ছায় নানা কিছু করে। কার্ড, ফুল, চকলেট, লটারি, বিনোদন, ডেটিং, অশ্লীল বৈশিষ্ট্যের পার্টিতে যোগদান, নানা কিছু উপহার দেওয়া, মন বিনিময়, মত বিনিময় এ দিবসের মূল লক্ষ্য। উপহারকে যে যত বেশি আকর্ষণীয় করতে পারে, তার ভালোবাসা যেন ততই পূর্ণতা লাভ করে।

ভাষার মাস যেন ভালোবাসার মাসে পরিণত হয়ে যায়। বৈধ কি অবৈধ, ন্যায় কি অন্যায়, কল্যাণ কি অকল্যাণ- এ যেন বিবেচনার সুযোগ নেই। ভালোবাসা বললেই যেন বৈধ কথাটা হারিয়ে যায়। কিন্তু কেন? 

আজকের সমাজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের নামে যে মাতামাতি করছে তা বিজাতীয় সংস্কৃতি। অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞতাবশত অন্ধভাবে অনুকরণ করছে।

অন্যান্য দিবসের মতো বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমরা কি উপকৃত হয়েছি? কেউ কেউ হয়তো হ্যাঁ জবাবকে বেছে  নেবেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই মনে করেন, ভালোবাসা দিবস সমাজকে অশ্লীল ও অন্যায়ের দিকে ধাবিত করছে। নৈতিক অবক্ষয় দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অভিভাবকগণ সঠিকভাবে সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিলে হয়তোবা অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে না।

ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও গোটা দেশকে ভালোভাবে গড়তে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা-না হলে, ভালোবাসা দিবস পালনের নামে আমাদের বোন, আমাদের সন্তানরা নৈতিক অবক্ষয়ের অতলে হারিয়ে যাবে। সমাজ পতিত হবে বিশৃঙ্খলার অতল গহ্বরে। যার আলামত আমাদের চারপাশে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজকাল ধর্মের কথা শুনলেই অনেকেই নাক সিটকান। কারণ তাদের কাছে ধর্ম মানেই পশ্চাৎপদতা, মৌলবাদিতা; ধর্ম মানেই সেকেলে বিষয়। তাই তারা নিজেদের এক আধুনিক সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। কিন্তু বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের নামে যে অশ্লীলতার চর্চা চলছে, তা বন্ধ না হলে তাদের সেই তথাকথিত সভ্য সমাজটাও পারিবারিক-সামাজিক কলহ এবং অশান্তির আগুনে পুড়ে ছারখার হতে বাধ্য।

অতএব, আসুন- আগে আমরা নিজেরা সচেতন হই, সচেতন করি আমাদের আশেপাশের সবাইকে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনের নামে আমাদের নৈতিক অবক্ষয় থেকে সমাজকে বাঁচাই, সতর্ক হই আমাদের পরিবার ও সমাজকে অশ্লীলতা থেকে বাঁচাতে।

(লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।)

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়