ভাইবোনের কাণ্ড
সাদিয়া আক্তার ছন্দা || রাইজিংবিডি.কম
ঈদের মধুর স্মৃতিগুলো ফেলে এসেছি কৈশোরে। দুষ্টু-মিষ্টি সম্পর্কগুলো কতই না সুন্দর ছিল। ঈদ মানেই আনন্দ। ছোটবেলায় ঈদের কথা মনে পড়লে এখনো স্মৃতিকাতর হয়ে যাই। ছোটবেলার ঈদ পালন অন্যরকম ছিল। প্রত্যেক ঈদে আমার ফুপাতো ভাই-বোনেরা চলে আসতো আমাদের বাসায়। সবাই মিলে অনেক মজা, হৈ হুল্লোড়, আনন্দ আড্ডায় কাটতো।
২০১৫ সালের একটা ঘটনা বলি। তখন আমার ফুপাতো বোনের বিয়ে হয়ে যায়। যার কারণে আপুর সঙ্গে তখন থেকে আর ঈদ করা হয়নি। তো রীতিমতো আমার দুই ফুপাতো ভাই চলে আসে আমাদের বাসায়।
ঘটনাটা রোজার ঈদের। সমিতি করে ২০ জন মিলে কেনা গরু আমাদের বাড়িতে রাখা হয়েছিল। ফজর নামাজ পর গরু জবাই করা হবে। এজন্য গরু বাড়ির মেইন গেটে রাখা হয়। দায়িত্বে ছিল আমার দুই ফুপাতো ভাই। রাত জেগে আড্ডা দিবে আর গরু পাহারা দিবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা আর কি! সঙ্গে যোগ দিয়েছিল আমার ছোটো ভাই সিফাত। রাত জাগতে জাগতে সিফাতের ঘুম পেলে সে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
বাকি দুই জনের মাথায় তখন দুষ্টু বুদ্ধি চাপে। হটাৎ মাঝরাতে চোর চোর বলে চিল্লানো শুরু করে। লোকজন আওয়াজ শুনে বের হয়ে ভুল করে আবছা আলোয় বেচারা দুজনকে মারতে থাকে। তখন আব্বু রুম থেকে বের হয় লাইট নিয়ে। গিয়ে দেখে চোর বলে ভুল করে লোকজন আমার দুই ফুপাতো ভাইকে মারছে। তখন আব্বু লোকজনকে সরিয়ে দেয়। ততক্ষণে ওই দুটোর অবস্থা কাহিল। হাস্যকর হলেও খুবই দুঃখজনক। পরদিন সকালে ব্যথা কমলেও ওদের শরীর, মুখ জখম হয়ে গিয়েছিল। রাগে, দুঃখে বেচারা দুইটা বাড়ির বাইরেই যায়নি আর লজ্জায়।
ওদিকে আমিও খুব একা বোধ করছিলাম। সকালে সালামি সংগ্রহ করে বসে গেছিলাম আমার হাতের স্পেশাল কাবাব বানাতে। পরে নামাজ শেষ করে আব্বু বাসায় এলে সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করলাম। তারপর দেখি সময় অনেক পড়ে আছে, একাকী সময় কাটছে না। তাই একটু পর পর আম্মুর কাছে গিয়ে গিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করছিলাম, ঘুরতে যাওয়ার অনুমতির জন্য। অনেক কষ্টে রাজি করালাম। শর্ত হলো বান্ধবীদের নিয়ে একসাথে ঘুরতে যাবো আর বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসবো।
ঘোরাঘুরির সীমারেখা বাসার কাছেই নদীর পাড়। আমার খুশি আর দেখে কে! বান্ধবীদের ফোন করে রেডি হয়ে বের হতে যাব, ঠিক তখনই আমার ছোটভাই সামনে হাজির। বায়না হলো সালামি লাগবে। আমি তাড়াহুড়োয় ব্যাগে হাত দিয়ে ৫০ টাকা বের করতে গিয়ে ৫০০ টাকায় নোট যেই না ভুলে বের করেছি, অমনি সে টাকাটা খামচি দিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালালো। রাগ করতে গিয়েও করলাম না। ওকে আর কিছু না বলে আমি বাসায় পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে রওনা দিলাম নদীর পাড়ের রাস্তায়। গিয়ে দেখি মানুষজন যাওয়া শুরু করেছে।
নদীর পাড়ে একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছিল। আমরা ভেতরে ঢুকে ফুচকা আর কোল্ড ড্রিঙ্কস অর্ডার করলাম। এদিকে আমার বান্ধবী মুনিয়া নৌকায় ঘোরার বায়না করেছে। মাঝির সঙ্গে কথা বলে ঠিকও করে ফেললো। তখন ফুচকা অর্ডার বাতিল না করে এবং কোনোকিছু না বলেই আমরা পাঁচজন বের হয়ে নৌকায় উঠে গেলাম। ২৫-৩০ মিনিট পর আমরা একটা চরের দেখা পেয়ে নেমে পড়ি। নেমে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি, সেলফি তোলায় ব্যস্ত থাকায় খেয়ালই করিনি কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
ওদিকে মাঝিরও হুঁশ ছিল না, নৌকায় ঘুমাচ্ছিল। তারপর আমরা মাঝিকে ডেকে তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে যেখান থেকে উঠেছিলাম, সেখানে নিয়ে যেতে বলি।
নৌকা থেকে নামার সময় ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করলে মাঝি ১০০০ টাকা চেয়ে বসলো। সে নাছোড়বান্দা, ঈদের দিন বলে কথা। এক টাকাও কম রাখবে না। তার মধ্যে আমরা দেরি করিয়েছি তাকে। সে যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, এটা কোনো দোষ না। যাই হোক, আমি সবাইকে বললাম, জন প্রতি ২০০ করে দিলেই তো ১০০০ হয়ে যায়। তখন সবাই চুপ। কেউ টাকা নিয়ে যায়নি।
কি আর করা! আমার ব্যাগে থাকা শেষ সম্বল, সকালে পাওয়া সালামি নৌকা ভাড়া দিয়ে যেই পাড় থেকে রাস্তায় গিয়ে উঠেছি, ওমনিই রেস্টুরেন্টের ছেলেটা আমাদের দেখে দৌড়ে এলো। বলল- ‘আপু, ফুচকা অর্ডার করেছিলেন পাঁচ প্লেট। এখন টাকা দেন।’
শুনেই আমাদের মাথায় হাত। সবাই মিলে দিলাম দৌড়। ভাগ্যক্রমে একটা খালি অটো পেয়ে উঠে গেলাম সবাই মিলে। বাসায় গিয়ে নেমে দেখি আব্বু গেটে দাঁড়িয়ে। আমি তো ভয়ে শেষ, আজ বকা খাওয়া ফরজ। তবে ভাগ্য ভালো খুব বেশি দেরিও হয়নি, যদিও চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছিল। কিন্তু বান্ধবীরা সাথে ছিল বলে আব্বু কিছু না বলে অটো ভাড়া দিয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমি দেইনি বলেই বাসায় ঢুকে পড়ি। সেদিনকার মতো বেঁচে যাই। পরে আম্মু সবটা সামলে নিয়েছিল।
আমার জীবনে এটা ছিল অন্যরকম একটা ঈদ। এখন এসব সিনেমাটিক কাহিনি মাঝে মাঝে মনে পড়লে হাসি পায়। রোমাঞ্চকর এই কাহিনি আমার জীবনের স্মরণীয় ঈদ স্মৃতি হয়ে থাকবে।
-শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন-
/মেহেদী/এসবি/লিপি/