ঢাকা     শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১২ ১৪৩১

পুরোনো সেই ঈদের স্মৃতি

মো. ফজলে রাব্বী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৬, ৭ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১৭:৫৩, ৮ এপ্রিল ২০২৪
পুরোনো সেই ঈদের স্মৃতি

চাঁদ দেখার পর বিটিভিতে কাজী নজরুল ইসলামের রচিত একঝাঁক শিল্পীর ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’- গানটি দিয়ে শুরু হতো আমাদের ঈদ। এখনও গানটি শোনার সাথে সাথেই কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা উদ্বেলিত হয়ে যায়। মনে করিয়ে দেয় পুরোনো সেই ঈদের স্মৃতিগুলো। 

রমজান মাসে আব্বুর সাথে রোজার বাজার দিয়ে শুরু হতো ঈদের আনন্দ। রোজা রাখতে হবে এর জন্য মাকে সেহেরিতে ডেকে দেওয়ার বায়না ছিল আনন্দ। যখন আমাকে ডাক না দিয়ে সবাই সেহরি করলে অনেক সময় রাগ করে কান্না করতাম। প্রতিবেশীদের ইফতার দিতে যাওয়ার মধ্যেও আনন্দ কাজ করতো। 

শৈশবে রমজান মাসের শুরু থেকেই ঈদ উদযাপনের আমেজ শুরু হতো। প্রতিরাতে তারাবির নামাজ পড়ার অজুহাতে বন্ধুদের সাথে মসজিদে গিয়ে দুষ্টুমি বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি ছিল নিয়মিত ব্যাপার। ঈদের জামাকাপড় কিনে কাউকে দেখানো যাবে না দেখালে সেটা পুরাতন হয়ে যাবে। এক সপ্তাহ আগে ঈদের বাজার থেকে শুরু করে চাঁদ রাতে হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে শুরু হতো ঈদের আনন্দ। চলতো ঈদের পরবর্তী আরও এক সপ্তাহ।

আরো পড়ুন:

আমরা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য বাহারি ঈদ কার্ড বিনিময় করতাম। আমার মনে পড়ে, স্কুলে টিফিনের টাকা জমিয়ে ২০০৭ সালে মাত্র ১১০ টাকায় অসাধারণ একটি ঈদ কার্ডের দোকান দেওয়ার কথা। ঈদ কার্ড বিক্রি করে যে টাকা আসবে সেটা দিয়ে ঈদে ঘোরাঘুরি করার পরিকল্পনা ছিল। মহল্লায়, স্কুলের প্রিয় বন্ধুদের তাদের পছন্দের ঈদ কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

কিন্তু এখন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানানোর মধ্যে দিয়ে হারিয়ে গেছে আমাদের শৈশবের সেই ঈদ কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর প্রথা।

বাবা-মার সাথে শিশু-কিশোর বয়সে প্রায় সময়ই ঈদ করতে সপরিবারে গ্রামে দাদা-নানার বাড়ি যেতাম। মনে পড়ে আত্মীয়-স্বজনের সাথে অনেক দূর হেঁটে ঈদের জামাতে অংশ নিতাম। দীর্ঘদিন পর কত আপনজনদের দেখা পেতাম। ঈদ নামাজ আদায় করতে গিয়ে গ্রামের বাবার সাথে কত মুরুব্বীদের দেখা হতো। আর বর্তমান তরুণ বয়সে আমার ঈদ নিয়মিতভাবেই মফস্বল শহরে হতো।

ঈদের দিন নতুন জামা-কাপড় পরে সুগন্ধি মাখিয়ে সেমাই মুখে দিয়ে বাবার সাথে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ পৌঁছানো এবং অন্য রাস্তা দিয়ে বাসায় আসাই ছিল প্রথা। নামাজের পর আমাদের প্রধান কাজ ছিল, বড়দের সালাম করে তাদের ঈদ মোবারক জানিয়ে সালামি আদায় করা। কে কত টাকা ঈদ সেলামি পেলাম, এইটা নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতাম। তারপর বন্ধুদের সাথে অজানা উদ্দেশ্যে হারিয়ে যাওয়া। আর বড়বেলায় যখন নিজের আলাদা একটি পরিবার হলো, তখন ভাই-বোনদের, সন্তানদেরকে আনন্দ দেওয়ার মাঝেই অনেকটা নিজের আনন্দ খুঁজে নিতে হয়। তাই এটা অনস্বীকার্য যে, শৈশব-কৈশোরের ঈদ আনন্দের স্মৃতিই সবার মনে চিরস্থায়ী রয়ে যায়।

নব্বইয়ের দশকে ঈদ বিনোদনের প্রধান মাধ্যমই ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। সেই যুগে বিটিভিতে প্রচারিত হওয়া হানিফ সংকেতের উপস্থাপনায় ‘ইত্যাদি’ ছিল অন্যরকম এক আকর্ষণ। 

এ অনুষ্ঠানের জন্য বছর ঘুরে ঈদের জন্য পরিবারে সবাই অপেক্ষা করতাম। তখনকার সময়ে ক্যাবল নেটওয়ার্ক খুব কম ছিল। আর ইন্টারনেট নামে কোনো উপাদানের অস্তিত্ব জানা ছিল না। তাছাড়া ঈদ উপলক্ষে বিটিভিতে প্রচারিত অন্যান্য চলচ্চিত্র, নাটক ছিল আমাদের বিনোদনের বিশেষ আকর্ষণ।

আরেকটা রেওয়াজ ছিল, ঈদের আগের দিন থেকে ঈদ উপলক্ষে মুক্তি পাওয়া নতুন নতুন গানের অ্যালবাম পাড়া-মহল্লায় ক্যাসেট প্লেয়ার কিংবা সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে বাজানো। বিটিভিতে প্রচারিত ছিল যান্ত্রিক বিনোদন মাধ্যম। 

সময়ের সাথে সাথে যেমন ঈদের রঙ বদলায় তেমনি আমাদের বয়সের সাথে  সাথে  উদ্‌যাপনের ধরনেও এসেছে পরিবর্তন। বর্তমানে কেউ আর ঈদে নির্দিষ্ট কোনো অনুষ্ঠান দেখার জন্য অপেক্ষা করে না। টিভিতে ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, চরকি সেই জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। একটু অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি আর গ্রামে যান না, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে ঘুরে বেড়ান। দীর্ঘসময় জ্যামে আটকে থেকে টিকিট কেটে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার যে আনন্দ, সেটা এই প্রজন্ম হয়তো বুঝবে না। সালামিতে ১০ টাকা ২০ টাকার নতুন নোট পেলে মনে যে খুশি কাজ করতো, সেটা এখন হাজার টাকা খরচ করেও আর পাই না। হয়ত আর পাবো না।

এখন ঈদের দিনও দেখা যায়, অনেকের মধ্যে ঈদ খুশি কাজ করে না। বড় হওয়ার সাথে সাথে ঈদের খুশি চিন্তা ও দায়িত্বের কাছে হেরে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তা হতাশার কাছে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সেই ঈদ। আর পাব না সেই ঈদ, পাব না সেই শৈশব। পারবো না ফিরে যেতে আমার সেই সোনালী অতীতে, পারবো না বাবার হাত ধরে ঈদগাহে যেতে। সময়ের সাথে সাথে অনেক আপনজন চলে গেছেন, রেখে গেছেন স্মৃতি। নতুন পরিবার আর নতুনদের মধ্যে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি নতুন ঈদ খুশি।

-শিক্ষার্থী, আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন-

মধ্যবিত্ত হাসি

ভাইবোনের কাণ্ড

আব্বুকে হারানো ঈদ

জলরঙের ঢেউ

দীর্ঘ অপেক্ষার ঈদ

আনন্দ-বিষাদের ঈদ

শৈশবের ঈদ

২০ টাকা সালামি

ঈদের সেরা মুহূর্তনামা

/মেহেদী/এসবি/লিপি/

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়