আনন্দ-বিষাদের ঈদ
সালেহ আরাবী || রাইজিংবিডি.কম
সম্ভবত সময়টা ২০১৭ সাল হবে। আমরা দু’ভাই গ্রামে আগেভাগেই চলে গেছি। গাজীপুরে ফ্যামিলিসহ থাকি সবাই, সেখানেই একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করি। ভাই-বোন বেশি হওয়ায় এক ঈদেই কাপড় পাওয়া হয় সবার; ঈদুল আযহায় কুরবানি দেওয়ার কারণে নতুন কাপড় ক্রয় করা হয় না। শহর থেকে গ্রামে আসার একটা বড় রকমের খরচের জন্য ঈদুল ফিতরেও সেবার নতুন কাপড় কেনা হয়নি। তবু আমি আম্মাকে ফোন দিয়ে একটা পাঞ্জাবি আনতে বললাম। আব্বুকে বলে কয়ে যাতে একটা নতুন পাঞ্জাবি নিয়ে আসে আমার জন্য।
চাকরির কারণে আম্মা ও ছোট বোনসহ ঈদের আগেরদিন রাত্রে আসলেন আব্বু। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। কথাবার্তার শব্দে এবং আম্মার ডাকে জেগে উঠলাম। আম্মা ব্যাগের চেইন খুলে একটা আকাশি রঙের পাঞ্জাবি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই নে তোর পাঞ্জাবি।’ আমার ঘুম ঘুম ভাব পুরো টুটে গেল। পাঞ্জাবি হাতে পেয়ে শিশুর মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম। শুধু আমারই না, আব্বু বোনাস পাওয়ার সুবাদে ভাই-বোন সবারই জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনেছেন।
নতুন জামা-কাপড় ছাড়া ঈদ করতে হবে না আমাদের, ভেবেই আনন্দে আত্মহারা হলাম। সেদিনের সেই খুশির মুহুর্তটা আজো মনে পড়ে। ছোটবেলায় নতুন জামা না পেলে, ঈদের আনন্দই যেন অপূর্ণ থাকতো। আর এখন যখন দরকার হয়, কিনে ফেলি। ঈদ কেন্দ্রিক সেই আনন্দ উচ্ছলতা এখন কেমন জানি হারিয়ে গেছে বয়স বাড়ার সাথে সাথে। ঈদের আগের সেই সুন্দর অনুভূতি, জামা দেখালে পুরাতন হয়ে যাবে এই ভয়ে কাউরে জামা না দেখানোসহ ব্যাপক প্রস্তুতি চলত। মেহেদি লাগানোর ধুম পড়ে যেত। যে ভালো মেহেদি লাগাত, তার কাছে সিরিয়াল লেগে যেত। ঈদ সেলামি, ঘোরাফেরা সবকিছুর মাঝে একটা অন্যরকম আনন্দ ছিল। আচ্ছা, মানুষ বড় হয়ে গেলে সমানুপাতিক হারে জীবনের আনন্দ-উচ্ছলতা কমে যায় কেন?
অবশেষে নিজ গ্রামে
সময়টা ২০১৮ সাল হবে। সেবার ঈদুল ফিতরে বাড়ি যাওয়া হলো না আমাদের। দাদাও এসেছে গ্রাম থেকে আগেই। কিন্তু বাস না পাওয়ার কারণে বাড়ি যেতে পারলো না দাদাও। আমার ইচ্ছে ছিল গ্রামে গিয়ে ঈদ করা। সেবারই প্রথম গ্রামে না গিয়ে শহরে অবস্থান করলাম ঈদের সময়ে। কোনো আনন্দ-উত্তেজনা কাজ করছে না। গ্রামের ঈদগাহ মাঠবিহীন ঈদের নামাজ, শৈশব-কৈশোরের সঙ্গীদের ছাড়া, নিকটাত্মীয়-পরিচিতজন ছাড়া এখানে একা একা ঈদ করতে হবে, শুধু পরিবারের সদস্যদের সাথে। বিষয়টা মেনে নিতে পারলাম না আমি। দাদার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, তিনিও টিকেট পেলেন না। নিজেই আটকে গেলেন এখানে। ধুর! এবারের ঈদটাই মাটি হলো। ঈদের আগের দিন রাতে এসব ভাবছিলাম আপন মনে।
পরদিন ঈদগাহে না গিয়ে, মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করলাম। মনে আনন্দ নেই। নামাজ পড়ে এসেই দাদা বললেন, 'চল বাবু, বাড়িতে যাব। এখানে আর মন টিকছে না আমার।'
ব্যাগটা কোনোমতে গুছিয়ে দাদার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। মেইন রোডে গিয়ে বাসে করে চৌরাস্তায় গেলাম। সেখানে শেরপুরের বাসে উঠলাম দুজন। একি! পুরো বাস ভরতি লোকজন।
আমার ধারণা ছিল, ঈদের দিন হয়তো ফাঁকা পাবো। লোকজন তেমন থাকবে না গাড়িতে। কিন্তু বাসে উঠে ধারণা পাল্টে গেল আমার। হয়তো যারা আগে যেতে পারেনি টিকেট এবং বাস না পাওয়ার জন্য, তারা ঈদের দিনই যাচ্ছে অন্তত ঈদের পরের কয়েকটা দিন পরিবারের সাথে কাটাতে পারবে এই ভেবে।
বাড়ির মত শান্তি আসলে দুনিয়ার কোথাও নাই, যদিও বাড়ি তেমন সুন্দর নাও হয়, ইটের পাঁকা দালান নাও হয়। এই যে, আমি ও দাদা যে ছুটে চলছি ঈদের দিনে, সেটা নাড়ির টানে, বাড়ির টানে। যদিও আমার পরিবার ছিল এখানে, তবু গ্রামে ঈদ করার কারণে আস্তে আস্তে একটা টান তৈরি হয়ে গেছে জন্মভূমির প্রতি, যা আমি এড়াতে পারিনি। ভেতরে টুল নিয়ে দাদা বসতে পারলেন, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। তবু খুশি হলাম বাড়ি যেতে পারছি, এ কারণে।
অনেকেই বাড়ি যেতে পারে না বিভিন্ন কারণে, পরিবার ছাড়া ঈদ করে। এটা কতটা কষ্টের, তা বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না। সবাই সবার প্রিয়জনের সাথে ঈদ উদযাপন করুক সেই প্রত্যাশাই করি সবসময়। পরিবার ছাড়া কারো ঈদ না কাটুক। আনন্দের দিনে, বিষাদের ঢেউ কারও মনে যেন আঘাত হানতে না পারে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি।
মারাত্মক অসুস্থ আমি
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। হল ছেড়ে নতুন একটা বাসা নিয়ে সেখানে উঠলাম। হলে সিট ক্রাইসিস, নতুন ব্যাচ ঢোকা ও পুরনো ব্যাচ বের না হওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। যা হোক, নতুন বাসায় আসার সাত দিনের মাথায় অসুস্থ হয়ে গেলাম। পেটে ব্যথা, হজম ঠিকমতো হচ্ছে না, টয়লেট করতেও সমস্যা। প্রথমে ভার্সিটি মেডিকেলে গেলাম, সেখানে কিছু ওষুধ পত্র দিল। এনে খেলাম ২-৩ দিন। কোনো উপকার পেলাম না তেমন।
পরে বন্ধু ফারুকের সাথে চট্টগ্রাম মেডিকেলে গিয়ে ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার কিছু নির্দেশনা ও ওষুধ প্রেসক্রাইব করলেন। ওষুধ নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরলাম। ইসবগুল, চিড়া, পেঁপে ইত্যাদি খাবার খাচ্ছি। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড জ্বরও আসছে। কিছুই খেতে পারছি না। হজম ঠিকমতো না হওয়ার জন্য, টয়লেটেও সমস্যা। যা হোক, ৬/৭ দিন পর আমার কাজিন শাওন কুমিল্লা ঘুরতে এসে আমার এখানে আসল। ওর সাথেই পরদিন রাতে ট্রেনে চাপলাম, বাড়ির উদ্দেশ্যে। নতুন বাসায় উঠার ১৬ দিনের মাথায় বাড়ি চলে আসলাম। বাড়িতে এসে ২-৩ দিন পর জ্যেঠার কর্মক্ষেত্র- ইসলামি ব্যাংল সেন্ট্রাল হসপিটাল, কাকরাইল গিয়ে সেরা গ্যাসট্রোলজিস্ট দেখালাম। বাড়ি এসে ওষুধ খেলাম এক সপ্তাহ। নাহ্, কোনো ধরনের উন্নতি নেই পেটে ব্যথার। জেঠা আরও এক সপ্তাহ ওষুধ খেয়ে যেতে বলল, আমিও চালিয়ে গেলাম। ১৭ দিন এভাবে খাওয়ার পরও পেটের সমস্যা গেল না।
এরপর আব্বুর সাথে বারডেম জেনারেল হসপিটালে গেলাম সেখানেও গ্যাসট্রোলজিস্ট ডাক্তার দেখালাম। কিছু লক্ষণ তখন দেখা দিয়েছিল নতুন করে- হালকা কাশি, প্রচন্ড জ্বর আর পেটে ব্যথা। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠাল। সেখানে বুক এক্স-রে করার কথা লেখা ছিল। রিপোর্ট নিয়ে বারডেমে ডাক্তারের জন্য ঘুরলাম দুই দিন, পেলাম না। সেখান থেকে ইসলামি ব্যাংল সেন্ট্রাল হসপিটালে গিয়ে ইমার্জেন্সিতে দেখিয়ে প্রথম বুঝা গেল আমার টিবি পজিটিভ।
এই এক-দেড় মাস ভুল চিকিৎসা করেছি আমি। দাদার এক কালের বন্ধু রিটায়ার বক্ষব্যাধি চিকিৎসকের ওখানে গেলাম এবার। তিনি কফ পরীক্ষা করার কথা বললেন। উত্তরায় ফ্রি কফ পরীক্ষা করতে দিয়ে আসলাম। দু’দিন পর রিপোর্ট নিয়ে আবার গেলাম উনার কাছে। অল্প পরিমাণ যক্ষ্মার জীবাণু পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে ফ্রি-চিকিৎসা আছে এটার জন্য। ছয় মাস মেয়াদি কোর্সে ওষুধ খেতে হয়, এমনকি পরিবারের সদস্যদেরও খাওয়া লাগে। এমনি তালপাতার সেপাই আমি। শরীর শুকিয়ে গেছে আরও, খেতে পারছিও না। দেখতে কঙ্কালসার লাগছে। প্রচণ্ড পেটে ব্যথা।
এক মাসের ওষুধ দিয়ে দিল ব্র্যাক যক্ষ্মা নিরাময় কেন্দ্র থেকে। এসে ওষুধ খেয়েই প্রথম দিন বমি হলো। এভাবে ওষুধ খাওয়ার পরই বমি হতে লাগল প্রতিদিন। এভাবে প্রায় মাসখানেক বমি হয়েছে। সাথে পেটের ব্যথা তো ছিলই। কিছু খেতে পারতাম না ঠিকমতো। খেলেই ব্যথা শুরু হয়ে যেত। আর প্রচণ্ড জ্বর ছিল। কাশির উপসর্গটা তুলনামুলক কম ছিল আমার।
রমজান আসলো, ৯টি রোজা রাখলাম কোনোমতে, এরপর আর রাখতে পারলাম না, ব্যথা ও অসম্ভব কষ্টের জন্য।
এভাবেই ঈদ আসলো। ছোট ভাই-বোনসহ বাবা গ্রামের বাড়িতে গেল। আম্মা, একেবারে পুঁচকে ভাইটা এবং আমি রয়ে গেলাম গাজীপুরে। ঈদের দিন সকালে কোনোমতে নামাজ পড়ে এসেই শুয়ে পড়লাম। দুপুরের পর বন্ধু-বান্ধব সবাই আসল। এর আগেও এসেছে ওরা। একসাথে ইফতার পার্টিও করেছিলাম একটা। যদিও রোজা ছিলাম না আমি। প্রতিবছরই আমরা বন্ধুরা মিলে এরকম ইফতার পার্টি করি। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। ওরা নাস্তা খেল শুধু, কেউ ভাত খেল না।
আড্ডা, হাসি-ঠাট্টায় আমাকে মাতিয়ে রাখতে চেষ্টা করল ওরা। আসরের আগে আগে ওরা চলে গেল। ঈদের দিন বাইরে না বেরিয়েও অনেক আনন্দ লাভ করলাম, ঘরে বসেই। এমন বন্ধুদের পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো। আরেকজনের কথা না বললে এ ঘটনা অপূর্ণ থেকে যায়। সে হচ্ছে - আমার সাবেক প্রেমিকা, বর্তমান স্ত্রী। এ মেয়েটার সাথে সবচেয়ে বেশি খারাপ ব্যবহার করেছি সে সময়। তবু হাসিমুখে সেসব সহ্য করে, সান্ত্বনা দিয়ে গেছে, সাহস জুগিয়েছে, হতাশার মাঝে আশার আলো দেখিয়েছে। স্থানের দূরত্ব বিস্তর থাকলেও মনের দূরত্ব কখনোই ছিল না আমাদের মাঝে। সবসময়ই পাশেই ছিল যেন, এমনটাই মনে হত আমার।
হতাশায় মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে মন চাইত, মাঝে মাঝে মনে হত এ রোগ কোনোদিনই আর সারবে না আমার। আল্লাহর কাছে অভিযোগ করতে মন চাইত। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েও যেন পারতাম না। খুব অসহায় লাগত, মেজাজ অনেক খিটখিটে হয়ে গেছিল। ভালো কথাও তিতা লাগত। ছোট ভাইটাকে অবধি অসহ্য লাগত। এমন দুঃখজনক স্মৃতি সারাজীবনেও ভোলার মত নয়। আলহামদুলিল্লাহ, আস্তে আস্তে ভালো হয়ে গেছি যক্ষ্মা থেকে। এক সময়ের 'যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই’ রোগটি এখন ‘যক্ষ্মা কোনো রোগই নয়' স্লোগানে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এটার চিকিৎসা একদম ফ্রি। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, আমার মত দুরবস্থা আমার প্রাণের শত্রুরও না হোক। যে অবস্থার মাঝ দিয়ে আমি গেছি, তা সত্যিই অবর্ণনীয়।
-শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন-
/মেহেদী/এসবি/লিপি/