শৈশবের ঈদ
তৈয়ব শাহনূর || রাইজিংবিডি.কম
ঈদের স্মৃতি একেক জনের কাছে একেক রকম। তবে আমার কাছে ঈদের স্মৃতি হচ্ছে শৈশবের আনন্দ মাখা, রঙিন, অসাধারণ কয়েকটি দিন। আমার স্মৃতিতে ঈদ শুধু একটি দিন ছিল না। প্রতিবার মোটামুটি সপ্তাহ খানেক সময় ধরে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতাম।
আমি বড় হয়েছি গ্রামে। গ্রামের বেশিরভাগ কর্মক্ষম মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে ঢাকা, গাজীপুরের মতো শহরে কাজ করতেন। ঈদের দুই-তিন দিন আগে থেকেই দলবেঁধে মানুষ শহর থেকে গ্রামে আসা শুরু করতেন। বসন্ত আসার আগেই যেরকম সবুজ পাতা আর ফুলে ফুলে প্রকৃতি সেজে ওঠে, তেমনি ঈদের আগমনী বার্তা নিয়ে নতুন জামাকাপড় পরে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন শহর থেকে আসা মানুষেরা।
এরা গ্রামেরই- কারও সন্তান, কারও ভাই-বোন বা আত্মীয়-স্বজন। শহর থেকে পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন জামা-জুতো আর উপহার নিয়ে আসতেন তারা।
ঈদের দিন সকাল সকালই শুরু হতো সেমাই খাওয়ার ধুম। এ বাড়ি, ও বাড়ি সেমাই খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি, আমন্ত্রণ। শুরু হয়ে যেত পুকুরে দলবেঁধে ছেলে-মেয়েদের গোসল করে ঈদগাহ মাঠে যাওয়ার তাড়া। আগে থেকেই ভাজ করে রাখা নতুন জামা পরে বের হতাম আমরা। তারপর সব ছেলেরা দলবেঁধে কিচির-মিচির করতে করতে ঈদগাহ মাঠের দিকে ছুটতাম আমরা।
আশেপাশের কয়েকটা গ্রাম মিলিয়ে একটি মাত্র ঈদগাহ ছিল তখন। সবাই মিলে জড়ো হতো সেখানে। মাঠের চারপাশে ততক্ষণে জমে উঠতো বাচ্চাদের খেলনা, রঙিন বেলুন আর চটপটির দোকান। বড়রা যেত নামাজে আর ছোটদের আকর্ষণ ছিল সেসব দোকান।
কোরবানির ঈদ হলে নামাজের পর থাকতো আরেক উৎসব। গ্রামের কয়েকটি পরিবার মিলে গরু কিংবা ছাগল কোরবানি দিতেন। সবাই নিজেদের কোরবানির গরু নিয়ে মসজিদের পাশে, চার রাস্তার মোড়সহ কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো হতেন। সেখানে মাংস কাটা ও গ্রামের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে মাংস দেওয়া হতো মুরব্বিদের তত্বাবধানে।
বিকেল থেকে শুরু হতো ঘুরাঘুরি আর আড্ডা। বয়সভেদে লোকেরা তাদের গ্রুপ নিয়ে আড্ডা দিতেন। আমরা ছেলেদের দল অধিকাংশ সময় ঘুরতে চলে যেতাম পাহাড়ে। নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় আমাদের পাশের গ্রামেই ছোট ছোট পাহাড়, ঝর্ণা, ঐতিহাসিক সাত শহীদের মাজারের অবস্থান। সেখানে দিনভর ঘুরাঘুরি, খেলাধুলা হতো। কখনো কখনো দলবেঁধে সিনেমা দেখাও হতো।
ঈদ মৌসুমে আমাদের গ্রামের আরেকটা উল্লেখযোগ্য মজার বিষয় ছিল পাড়ার খেলাধুলা। তখন পাড়াতে জমজমাট খেলধুলার আয়োজন হতো। বেশিরভাগ সময় ফুটবল কিংবা কাবাডির মতো গ্রাম্য খেলাগুলো হতো। খেলার দল বাছাইটাও ছিল অনেক মজার। যেমন- বিবাহিত বনাম অবিবাহিত, গ্রামের থাকা দল বনাম শহর থেকে আসা দল, নদীর উত্তর পাড় বনাম নদীর দক্ষিণ পাড় কিংবা পূর্বপাড়া বনাম পশ্চিমপাড়া।
এভাবে হৈ-হুল্লোড়েই কেটে যেত কয়েকদিন। তারপর কর্মজীবী মানুষেরা শহরে যাওয়া শুরু করলে ঈদ মৌসুম শেষ হচ্ছে বোঝা যেত। লোকজন আবার আস্তে আস্তে কাজে ব্যস্ত হয়ে যেত। আর আমরা আরেকটা ঈদ কবে আসবে সেজন্য অপেক্ষা করতাম।
-শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন-
/মেহেদী/এসবি/লিপি/