ঢাকা     সোমবার   ০১ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৭ ১৪৩১

মে দিবস ও কিছু কথা

মোহাম্মদ নাদের হোসেন ভূঁইয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৩, ২৯ এপ্রিল ২০২৪  
মে দিবস ও কিছু কথা

পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিনটিকে আমরা মে দিবস বলেও জানি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম অধিকার আদায়ের এ দিনটি বছরের পর বছর ধরে বিশ্বব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের সম্মানে মে দিবসে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ। কিন্তু যাদের নিয়ে এই দিবস তারা এই সম্পর্কে কতটা অবগত? অনেক শ্রমিক জানেনই না এর ইতিহাস। আসুন আগে এর ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যাক।

উনিশ শতাব্দীর পূর্বে কারখানার শ্রমিকদের দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চাইতেও বেশি। কিন্তু কাজ অনুপাতে পারিশ্রমিক ছিল খুবই সল্প, যা তাদের তাদের জীবনধারণে যথাযথ নয়। একটা পর্যায়ে শ্রমিক পক্ষ ক্ষুব্ধ হতে থাকেন এবং সেটা আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক মালিকপক্ষকে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণের দাবি জানান। এ দাবি পূরণের সময় হিসেবে ১৮৮৬ সালের ১ মে’কে নির্ধারণ করেন শ্রমিকরা। কিন্তু কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের এ দাবি কানে তোলেননি।

ফলে ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেট নামক স্থানে ফের আন্দোলন গড়ে তোলেন শ্রমিকরা। এসময় হে মার্কেট স্কয়ারে শ্রমিকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন আমেরিকান লেবার অ্যাক্টিভিস্ট অগাস্ট স্পিস। উদ্বেলিত শ্রমিকদলের কিছু দূরেই ছিল পুলিশ। এসময় সবার অলক্ষ্যে হঠ‍াৎ পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ হলে নিহন হন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তাৎক্ষণিক এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক। পুলিশের ওপর কে বা কারা বোমা হামলা করেছিল তা জানা না গেলেও, পুলিশ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ও আটক করা হয় অগাস্ট স্পিসসহ আরও আটজনকে। পরের বছর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর অগাস্ট স্পিসসহ অভিযুক্ত ছয়জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি দু’জনের একজন কারাবন্দি অবস্থায় আত্মহত্যা করেন ও অন্য একজনের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়।

এ ঘটনার দু’বছর পর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের শত বছর প‍ূর্তিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে, শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে উদযাপনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রস্তাবনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না, ঠিক তখনই উন্মোচিত হয় শ্রমিক আন্দোলন ঘটনার এক মর্মান্তিক সত্য। প্রমাণিত হয় পুলিশের ওপর বোমা হামলার দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত অগাস্ট স্পিস ও বাকি সাতজন মূলত দায়ী ছিলেন না, তারা ছিলেন নির্দোষ। তবে আসল অপরাধীকে শনাক্ত করা যায়নি। য‍াই হোক, ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থ‍ানে শ্রমিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়তে থাকে। 

১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী মে মাসের প্রথম দিন মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এ আহ্বানের সাড়া দিয়ে বিশ্বের প্রায় সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশের শ্রমিকরা মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায়। বিভিন্ন দেশে মে দিবস সরকারিভাবে ছুটির দিন হিসেবে উদযাপিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ দিনটির তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার দাবি।

শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে মহান মে দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় মে দিবস।

দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য থাকে শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। যাতে করে তারা মে দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্ক জানতে পারে এবং নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য আমরা মে দিবস উৎযাপন করি, সেটা কতটা সফল হয় তা নিতে প্রশ্ন আছে। আসাটাও বেশ স্বাভাবিক।

মে দিবসের সকাল বেলার চিত্র- সব সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবুও কিছু মানুষকে দেখা যায় রুটিরুজির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে কাজে। কারণ একবেলা কাজ না করলে তার পরিবারকে কাটাতে হবে অনাহারে। কারও কারও আবার মেলেনি ছুটি।

৮ ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিয়ম চোখে পড়ার মতো। কাজ করতে হচ্ছে ৮ ঘণ্টার অধিক। তবে দেওয়া হচ্ছে না ওভার টাইম বা অতিরিক্ত সময়ের পয়সা। মে দিবস উৎযাপন তো এই মানুষগুলোর কাছে একপ্রকার বিলাসিতা। আমরা দেখি বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কর্মরত। প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানায় ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ হয় প্রতিদিন। আনুমানিক ৬৫ শতাংশের বেশি কারখানায় রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ হয়। তারপরও শ্রমিকদের যদি বলা হয়, আপনি ওভার টাইম করেন?

শুধু গার্মেন্টস নয়, অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি একজন বাস চালকের একটা সাক্ষাতকার দেখলাম। তিনি দিনে প্রায় ১৬-১৮ ঘণ্টা বাস চালান। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের জোরপূর্বক নয়, অনেকটা নিজের তাগিদে অর্থের লোভে পড়ে ওভার টাইম কাজ করছেন তারা। কিন্তু মালিকপক্ষের নেই কোনো তদারকি। মালিকপক্ষ নির্ধারণ করে দিয়েছে যত ট্রিপ, তত বেশি মজুরি। তাই তারা অতিরিক্ত সময় কাজ করতে আগ্রহী।

বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৯ প্রণয়ন করার পরও করোনা মহামারিতে অসংখ্য শ্রমিক হারিয়েছে তার আয়ের প্রধান উৎস। অফিসে চাকরি করেন এমন ১৩ শতাংশ মানুষ করোনায় এ পর্যন্ত কাজ হারিয়েছেন। চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই, এমন মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। আর ২৫ ভাগ চাকরিজীবীর বেতন কমে গেছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় জানা গেছে, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের হিসেবে করোনায় এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজার পোশাক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।

বিদেশে প্রবাসীদের অবস্থা আরও গুরুতর। ডব্লিউইএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী- করোনার কারণে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিরা কাজ হারিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে প্রবাসী আয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে।

তাছাড়া, বাংলাদেশে রানা প্লাজাসহ অনেক দুর্ঘটনায় অসংখ্য শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। সেই সঙ্গে হারিয়েছেন বহু আশা, স্বপ্ন। অনেক পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। সামান্য ক্ষতিপূরণে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অনেক সময় সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলেও মালিক-শ্রমিক সমন্বয়হীনতায় বৃথা যায় সব।

এতেই বোঝা যাচ্ছে, শ্রমিকদের অবস্থান কতটা শোচনীয়। এখনই সময় এসেছে সব শ্রমজীবীদের এগিয়ে আসার। মে দিবস পালনই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। মুখ্য উদ্দেশ্য হোক, শ্রমিকদের অধিকার আদায় ও নিরাপত্তা। ৮ ঘণ্টার অধিক কাজ নয়। এর বেশী কাজ করলে ওভার টাইম বা অতিরিক্ত সময়ের মজুরি দিতে হবে। ওভার টাইমের একটা নিদিষ্ট সময় থাকা প্রয়োজন। যাতে করে একটা শ্রমিক তার শরীরের সহনীয় পর্যায় পর্যন্ত কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশে অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন রয়েছে, যাদের যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে শ্রমিকদের দাবিগুলো মালিকপক্ষ বা সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারে। তাতে করে শ্রমিক এবং মালিক পক্ষের দূরত্ব অনেকটা লাঘব হবে। শ্রম অইনগুলো কঠোরতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে তৈরি করতে হবে শ্রমিকবান্ধব আইন, যা শ্রমিকদের স্বার্থে কথা বলবে। ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠবে একটি বৈষম্যহীন শ্রমিক সংঘ এবং এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি।

-লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ, ফেনী সরকারি কলেজ

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়