ঢাকা     মঙ্গলবার   ২২ এপ্রিল ২০২৫ ||  বৈশাখ ৯ ১৪৩২

উপাচার্য ও শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে অস্থির কুবি

রুবেল মজুমদার, কুমিল্লা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪২, ৩০ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১৯:০৪, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
উপাচার্য ও শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে অস্থির কুবি

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) চলমান উপাচার্য এএফএম আবদুল মঈনের সঙ্গে শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব দিনের পর দিন বাড়ছে। উপাচার্য অপসারণের দাবিতে সব প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেকিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। 

গত রোববার (২৮ এপ্রিল) শিক্ষকদের সঙ্গে উপাচার্যের পক্ষ নিয়ে ছাত্রলীগের মারামারির ঘটনায় একে অপরকে দায়ী করে সদর দক্ষিণ থানায় দুটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। শিক্ষকদের উপর ওই হামলার ঘটনায় আয়োজিত মানববন্ধনে কুবি উপাচার্যকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) সকালে শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা সাত দফা দাবি জানান।  

কুবির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। উপাচার্যের উপস্থিতিতে শিক্ষকদের ওপর হামলার বিচার, প্রক্টরের অপসারণ, ঢাকার গেস্ট হাউস অবমুক্তকরণ, অধ্যাপকদের পদোন্নতি, আইন মোতাবেক বিভাগীয় প্রধান ও ডিন নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে আইন বহির্ভূত অবৈধ শর্ত আরোপ নিষ্পত্তিকরণ, ৯০তম সিন্ডিকেট সভায় বিতর্কিত শিক্ষাছুটি নীতিমালা রহিতকরণ এবং ৮৬তম সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।’

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচারিতা, পদোন্নতিতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগ এনে উপাচার্যের বিরুদ্ধে একাট্টা শিক্ষকরা। আর নিজেদের প্রধান কাজ গবেষণা ও উন্নত জার্নালের জন্য প্রকাশনা না করায় শিক্ষকদের প্রতি ক্ষুব্ধ উপাচার্য। নতুন করে যোগ হওয়া শিক্ষকদের পদান্নতি নীতিমালা ও কুবির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানের ছুটি নিয়ে উপাচার্য ও শিক্ষকের দ্বন্দ্ব এখন চরমে। 

এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন অন্তত ১৯ জন। গত ২৮ এপ্রিল উপাচার্যের দপ্তরে তার পক্ষ নিয়ে ছাত্রলীগ শিক্ষকদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছে। এক পর্যায়ে হাতাহাতিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। পরে এ ঘটনার সুরাহা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা উপাচার্যের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সব মিলিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। 

এদিকে শিক্ষক ও উপাচার্যের চলমান দ্বন্দে নির্দিষ্ট সময় তাদের ক্লাস না হওয়ায় অ্যাকাডেমিক দিক দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া চলমান শিক্ষক আন্দোলনে অনেক বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছে।

কুবি শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘কিছুদিন পর পর শিক্ষক দ্বন্দের কারণে আমাদের ক্লাস পরীক্ষা হচ্ছে না। উপাচার্য স্যার চাইলে এ সমস্যার সমাধান করতে পারেন। কিন্তু এসবের সমাধান কেনো করেন না, তিনি ভালো জানেন। আমরা নিয়মিত ক্লাস চাই।’  

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী নূরজাত জাহান বলেন, ‘এমনিতেই করোনার কারণে ক্লাস বঞ্চিত হয়েছি। এখন শিক্ষকদের কারণে আমাদের ক্লাস ব্যাহত হচ্ছে। আমরা এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি চাই। আমরা ক্লাসে ফিরতে চাই। এ ক্ষেত্রে উপাচার্য স্যার এগিয়ে আসলে সব সমস্যার সমাধান হবে।’ 

বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন। যোগদানের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদে জ্যেষ্ঠদের পাশ কাটিয়ে কনিষ্ঠ শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়া, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া, পছন্দের শিক্ষকদের পদোন্নতি দিয়ে অন্যদের আটকে দেওয়াসহ একের পর এক নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা এবার উপাচার্যের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন।

শিক্ষকরা জানান, ২০২২ সালে কুবিতে উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন যোগদানের পর থেকে একের পর এক বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে নিজের বলয় তৈরি করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে নানা সময় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তারা উপাচার্যকেও বিপথগামী করছেন। ফলে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়ে সমালোচনার জন্ম দিচ্ছেন উপাচার্য। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করায় এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করাসহ শিক্ষকদের নিয়ে নানা কটূক্তি এবং সবশেষ হামলায় ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নির্দিষ্ট এক প্রার্থীকে নিতে অভিনব উপায়ে এক অনুবিধি যোগ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তিনি। অনুবিধিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও আলোচিত না হলেও নির্দিষ্ট ওই প্রার্থীর যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তা প্রকাশ করেন উপাচার্য। ওই বিজ্ঞপ্তিটি বাতিল করতে শিক্ষক মহল থেকে আবেদন গেলেও তিনি তা গ্রাহ্য করেননি। আবেদন যাচাইয়ে অনিয়ম, প্রার্থীদের নিয়োগ পরীক্ষার খাতায় বিশেষ চিহ্ন ব্যবহারে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াসহ বিভিন্ন অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের অভিযোগ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ওই প্রার্থীকেই নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।

তবে প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষায় এক বোর্ড সদস্য তাকে নেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানালেও (নোট অব ডিসেন্ট) সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি তিনি। নিয়মানুযায়ী নিয়োগ বোর্ডের কোনো সদস্যের আপত্তি আসলে বিষয়টি সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপন করতে হয়। সিন্ডিকেটে পর্যালোচনা সাপেক্ষে ওই প্রার্থীর নিয়োগ চূড়ান্তকরণ হয়।

তবে ৮৬তম সিন্ডিকেট সভায় অংশগ্রহণকারী একাধিক সদস্য জানান, কোনো প্রার্থীর বিষয়ে আপত্তি সংক্রান্ত কোনো আলোচনাই সিন্ডিকেটে হয়নি। নিয়োগের এজেন্ডা আলোচনায় আসলে এক সদস্য সবকিছু ঠিক আছে কিনা জানতে চান উপাচার্যর কাছে। উপাচার্য হ্যাঁ সম্মতি দিয়েই ওই আলোচ্যসূচিটি সমাপ্ত করেন। ওই নিয়োগকে বৈধতা দিতে ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালাও পাশ করিয়ে নেন তিনি। নিয়োগপ্রাপ্ত সেই শিক্ষক আবু ওবায়দা রাহিদ বর্তমানে প্রশাসনের সহকারী প্রক্টর। উপাচার্যকে ‘শলা-পরামর্শ’ দেওয়া ব্যক্তিদের অন্যতমও তিনি।

আবার নিজ জেলা বরিশালের অন্তত ১০ জন কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এসব নিয়োগে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে জনশ্রুতি রয়েছে।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আইনে অধ্যাপকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পালাক্রমে তিন বৎসর মেয়াদে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ দেওয়ার কথা রয়েছে উপাচার্যের। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত পাঁচটি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে এ আইন ভঙ্গ করেছেন তিনি। বিধি মোতাবেক পদ দিতে উপাচার্য বরাবর চিঠিও দিয়েছেন একাধিক শিক্ষক।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আবু তাহের বলেন, ‘একজন উপাচার্য হয়ে তিনি শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতে পারেন না। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং এর সঙ্গে উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষক সমাজ এটা মেনে নিবে না। উনি (উপাচার্য) পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা এক চুল পরিমাণ আন্দোলন থামাবো না।’

সার্বিক বিষয়ে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য এএফএম আবদুল মঈন ‘সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মেনে শিক্ষক সমিতি আলোচনায় আসছে না। আমি এখন ঢাকা আছি।’ এটুকু বলেই কল কেটে দেন।

/মেহেদী/বকুল/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়