ঢাকা     রোববার   ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৮ ১৪৩১

ত্রি-শক্তি বনাম যুক্তরাষ্ট্র

শহীদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৩, ৪ জুন ২০২৪   আপডেট: ১৮:৩৪, ৪ জুন ২০২৪
ত্রি-শক্তি বনাম যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্বের পরাশক্তির দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রকে একঘরে করার জন্য চীন ও রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, চীন-রাশিয়া তাদের পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম ইরান।

ইরানে হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য রয়েছে। তারা সহজে আমেরিকার কাছে মাথা নত করতে নারাজ। ফলে নিজেদের শক্তি ও ঐতিহ্যে গৌরবময় হয়ে পরাশক্তির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। আর এই ইরানকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে চীন ও রাশিয়া। তাদের মিত্রতা এশিয়া মহাদেশেই নয়, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যেও বিরাট পরিবর্তন আনবে। আর তাদের এই শক্তিই আমেরিকার জন্য হবে দুঃস্বপ্ন। 

গতমাসে ইরানের প্রেসিডেন্টে রাইসির মৃত্যুতে চীন ও রাশিয়া গভীর শোক পালন করেছে। শুধু শোক নয়, তাদের পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে। কেননা রাইসিও রাশিয়া ও চীনের জন্য কিছু না কিছু দিয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পুতিন ইউক্রেনের উপর ক্রমাগত আক্রমণ করে যাচ্ছে। যাদের সহযোগিতা পাবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ইরান। কেননা দুজনেরই শত্রু এক।

রাইসির মৃত্যুর আগে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ইরানের গভীর সম্পর্ক ছিল। তাই আমেরিকার প্রবল নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া ও চীন ইরানকে সহযোগিতা করেছে। ইরানও রাশিয়াকে ড্রোন দিয়ে সাহায্য করেছে।  শুধু তাই নয়, মার্কিন কংগ্রেসের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে- রাশিয়া তাদের অভ্যন্তরে ইরানকে দিয়ে ড্রোন তৈরি করছে। আর সেই ড্রোন দিয়েই ইউক্রেনের উপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক তলানিতে। যে রাশিয়া ইউক্রেন দখল করার জন্য মরিয়া, সেই ইউক্রেনকে সাপোর্ট করছে আমেরিকা। ইউক্রেনকে ডলার ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করায় আমেরিকার উপর পুতিন ক্ষুব্ধ। আমেরিকার অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেন রাশিয়ায় আক্রমণ করেছে এবং সফলতাও পেয়েছে। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষোভ এবং ইউক্রেনকে সাহায্য করায় পুতিনও আমেরিকার উপর ক্ষুব্ধ। ফলে ইরান ও রাশিয়ার সম্পর্ক আরও মজবুত হচ্ছে।

বৈশ্বিকভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে অনেক রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি থেকে বের হতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াবে বলে মনে করে না অনেকেই। ফিদেল কাস্ত্রো দেশটি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো বন্ধু থাকলে শত্রুর প্রয়োজন হয় না।’

প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্রদের যেভাবে আশ্বস্ত করে, সেভাবে সাহায্য করে না। সেটাই অনেক রাষ্ট্র উপলব্ধি করছে। ইউক্রেনকে যেভাবে পূর্ণ আশা দিয়েছিল, সেটা তারা পূরণ করতে পারেনি। বরং তারা অস্ত্র ব্যবসায় লাভবান হচ্ছে। একই পরিস্থিতি তাইওয়ানের ব্যাপারেও।

তাইওয়ানকে চীন নিজেদের অংশ হিসেবে দেখে। কিন্তু তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন মনে করে এবং চীনের অধীনে থাকতে চায় না। তাই তারা মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হলে তারা তাদের পাশে দাঁড়াবে বলে চীনকে হুশিয়ারী দিচ্ছে। এই নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত। কিছুদিন পরপর চীন তাইওয়ানকে ঘিরে বড় বড় মহড়া দিচ্ছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রির জন্য তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে দিচ্ছে।

যুদ্ধ বাধিয়ে শুধু তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করবে এমনটা নয়, চীন চাইলে তাদের কাছেও করবে। তাই তাইওয়ানকে নিরপেক্ষ থাকা ভালো। তাইওয়ানকে এভাবে উস্কে দেওয়ায় চীনের সঙ্গেও আমেরিকার সম্পর্ক তলানিতে। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও পাকাপোক্ত ও মজবুত হচ্ছে। এখানেও তাদের শত্রু এক, আর তা হলো আমেরিকা।

অন্যদিকে চীনের সঙ্গে ইরানেরও গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ২০২১ সালে চীন ও ইরান চুক্তি করে। ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চীন বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দেশটি থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করেছে। এক জরিপে উঠে এসেছে, ইরান ২০২৩ সালে চীনে যে পরিমাণ তেল রপ্তানি করেছে, তা মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশ। 

এমনকি, গত ১৩ এপ্রিল ইরান ইসরায়েলের উপর হামলা করার পর চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেছে, এটা ইরানের আত্মরক্ষা।

মূলত ইরান রাশিয়া ও চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া ও চীনের সমন্বয়ে সম্প্রতি ব্রিকসে জায়গা পায় ইরান। যেখানে রাশিয়া ও চীন ছাড়াও ব্রাজিল,ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা রয়েছে। চীন ও রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো- বৈশ্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছোট করা এবং তার শক্তিমত্তাকে খর্ব করা। 

ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক দা-কুমড়ার মতো। ইসরায়েল হলো আমেরিকার মিত্র। ইরান হলো চীন ও রাশিয়ার মিত্র। ফলে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ইসরাইলের স্বভাবতই  দূরত্ব থাকবে। রাশিয়া ও চীন সিরিয়া-ইরানের ঘাঁটিতে ইসরায়েল কর্তৃক হামলার নিন্দা জানিয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলের উপর হামলা করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ৯ মাস ইসরায়েল হামাস ধ্বংস করতে গিয়ে অবিরত গাজা ও রাফাহ’তে হামলা করছে। এতে প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার  সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। এ ইসরায়েলকে সব রকমের সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে মুসলিম দেশগুলো আমেরিকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। শুধু মুসলিম দেশ নয়, ইউরোপের অনেক দেশ ফিলিস্তিনিদের প্রতি অখণ্ড সমর্থন দিচ্ছে। পুরো ইউরোপ জুড়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনবরত আন্দোলন চলছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের অধ্যাপকদের এজন্য বন্দী করা হয়েছে। এ আন্দোলন আমেরিকার পাশাপাশি বাইডেন প্রশাসনের জন্যও ক্ষতিকর। কারণ আগামী ৫ নভেম্বর নির্বাচন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাশিয়া ও চীন তাদের ফায়দা নিবে। নির্বাচনের জন্য বাইডেন প্রশাসন হয়তো বা কিছুটা সংকুচিত হবে। অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে ভাবতে হবে। কেননা নির্বাচনে হেরে গেলে আমেরিকার অনেক কিছুরই পরিবর্তন আসবে। কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যে নানা পন্থা অবলম্বন শুরু করেছে। নির্বাচনের জন্য বাইডেনকে ভালোই চাপে পড়তে হবে।

চীন, রাশিয়া ও ইরানের মিত্রতা আমেরিকার জন্য প্রকাশ্য হুমকি। রাশিয়া ও চীন চায় না ইরান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠুক। কিন্তু তাদের লাভের জন্য হয়তো ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশে রূপান্তর করবে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হতে পারে, তাহলে শুধু ইসরায়েলই নয়, আমেরিকার জন্যও দুঃস্বপ্ন হবে।

এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মনোভাব থেকে উঠে আসতে হবে। তা-না হলে, চীন-রাশিয়া-ইরানের মত শক্তিধর দেশগুলোর পাশে অন্যান্য দেশগুলো ভিড়বে। ফলে তাদের ত্রি-শক্তির কাছে যুক্তরাষ্ট্রকে পরাভূত হতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়