ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

কোটা নিয়ে বৈষম্যের কথা বলবে কে?

শহীদুল ইসলাম (শুভ) || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৫, ৩ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৮:৩৯, ৩ জুলাই ২০২৪
কোটা নিয়ে বৈষম্যের কথা বলবে কে?

দেশের উচ্চশিক্ষার কারিগর হলো বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকগণ। দেশের ভাবমূর্তি কেমন তা দেখার জন্য পুরো দেশ ঘুরে দেখার প্রয়োজন নেই। যেকোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখলেই দেশের পরিবেশ ও ভাবমূর্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মানী দিয়ে সম্মানিত করলে শিক্ষার মানের সঙ্গে দেশেরও উন্নয়ন হয়।

আজ যারা দেশ পরিচালনা করছেন, তারাও কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ভবিষ্যতেও যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হবেন। তাদের ভালো মানের শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন, ভালো মানের পরিবেশ ও শিক্ষা। সেই ভালো মানুষ তৈরি করবেন শিক্ষকগণ। সুতরাং তাদের সমস্যা মানে গোটা জাতিরই সমস্যা। 

নতুন অর্থবছর (২০২৪-২৫) শুরুর দিনে চালু হয়েছে সর্বজনীন পেনশন। স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীনে অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ, সরকারি ব্যাংক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, পেট্রো বাংলা, সাধারণ বীমাসহ প্রায় ৪০০ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এ পেনশনের আওতাভুক্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এ পেনশনের বিরোধিতা করে আন্দোলনের ঘোষণা বা কর্মসূচি দেয়নি।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এই প্রত্যয় পেনশনকে বৈষম্যমূলক বলে আখ্যা দিয়েছেন। কেননা এতে তাদের পূর্বের যে সুবিধাগুলো ছিল, সেগুলো থেকে তারা বঞ্চিত। বৈষম্যমূলক পেনশনের জন্য তারা সর্বাত্মক কর্মসূচি পালন করছে।

এজন্য দেশের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাত্মক বন্ধ দিয়েছে। ক্লাস, পরীক্ষা, অফিসিয়াল সব কিছু বন্ধ। এ বন্ধের ঘোষণায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের মানও ক্ষুণ্ন হবে। আন্তর্জাতিক মান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও দূরে সরে যাবে। বৈশ্বিক ছাত্রদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অনীহা চলে আসবে। করোনার প্রক্ষোপে যারা পিছিয়ে ছিল, তাদের জন্য বাঁধা হিসেবে দাঁড়াবে।   বিশেষ করে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের এ বন্ধের রেশ টানতে হবে। অনেকেই বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। অ্যাকাডেমিক পরীক্ষা শেষ হলে তারা পুরোপুরি চাকরির পরীক্ষার দিকে ঝুঁকবেন। কিন্তু এ সর্বাত্মক বন্ধের জন্য পরীক্ষা পিছিয়েছে। কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা শুরু হলেও এখন তা স্থগিত।

এখন আসি আসল কথায়, যে বৈষম্যের কথা শিক্ষকগণ বলছেন, তার চেয়ে ঢের বৈষম্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েক দশক ধরে হয়ে আসছে। এর জন্য নানা মহলে সমালোচনাও করে আসছে। বলছিলাম কোটার কথা। এ কোটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক ব্যাধি। সাধারণ পেনশনের আওতায় পড়ে বৈষম্যের কথা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাত্মক বন্ধ ও আন্দোলন করছেন; অথচ কোনদিন কোটা নিয়ে বা কোটার যৌক্তিকতা নিয়ে নৈতিক মূল্যবোধের দায়িত্ব থেকে কোনোদিন টু শব্দটিও করেননি। কোটার প্রয়োজন আছে কিনা, থাকলে কতটুকু প্রয়োজন বা কাটছাঁটের প্রয়োজন আছে কিনা তা নিয়ে কোনো ন্যায্য কথা বলেননি। একটা জাতির শিক্ষক হয়েও কোনদিন ওটা নিয়ে কথা বলেননি, সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াননি।  তাদের মা-বাবার পকেটের টাকা আপনাদের পকেটে কি ঢুকেনি?

যে বৈষম্যের কথা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ বলছেন, সেই বৈষম্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও হয়ে আসছে। কোটা দিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের অপসারণ করে  মেধাহীন শিক্ষার্থীকে সিট দিচ্ছে। মেধা তালিকায় ১২০০তম হয়েও আসন পাননি, অথচ তালিকায় ৪ হাজারের পরে থেকেও আসন পেয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। সেটা কি বৈষম্য নয়? নিজেদের বেলায় ষোলআনা, শিক্ষার্থীদের বেলায় এমন কেনো? 

২০১৮ সাল পর্যন্ত কোটা ছিল ৫৬%। আন্দোলনের পর নবম থেকে ১৩তম পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে। গত মাসে আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করলে ৫ জুন থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। সংবিধানের ২৯ এর ৩(ক) উপধারায় বলা আছে, ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ, যা থেকে প্রজাতন্ত্রের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূল বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ সেই সূত্রে ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০%, জেলা কোটা ৪০%, যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা ১০% ও মেধাবী কোটা ২০% করা হয়। ১৯৭৬ সালে জেলা কোটা ২০% কমিয়ে মেধা কোটা করা হয় ৪০%। ১৯৮৫ সালে করা হয় মেধা কোটা ৪৫%, নারী কোটা ১০%, জেলা কোটা ঠিক ছিল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫% করা হয়। ১৯৯৭ তে এসে প্রতিবন্ধী কোটা করা হয় ১%, মেধা কোটা করে ৪৪%।  সেই থেকে এখন পর্যন্ত মেধা কোটা ৪৪% রয়ে গেছে।

এখন একটা সমীকরণ করা যাক। ২০২২ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা আছে ২ লাখ (মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়), এ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা ৩০%। প্রতিবন্ধী আছে ২০ লাখ ১৬ হাজার, তাদের জন্য কোটা ৫%। এছাড়াও পোষ্যকোটা, নারী কোটা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটাসহ সবকিছু মিলে ৫৬%।

বিশ্লেষণে দাঁড়ায়, দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৬৩ শতাংশের জন্য কোটা ৫৬% আর ৯৭.৩৭ শতাংশের জন্য কোটা ৪৪%। এই বৈষম্য দেখে কি চোখ কপালে উঠে না? যে কারো চোখ কপালে ওঠার কথা। এ বৈষম্যের কথা কি শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীরা তুলে ধরবে? তারাই কি আন্দোলন করবে? জাতির রূপকার হিসেবে, গঠন হিসেবে, জাতির শিক্ষক হিসেবে কি এ বৈষম্যের কথা বলা উচিত নয়? কেনো ন্যায্য কথাটা একবারও তারা তুলে আনেননি? 

পেনশনের আওতাভুক্ত হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলনে নামলেন। আরও যে প্রায় ৩৯৯টি সংস্থা আছে, তারা তো বিরোধিতা করেননি, তারা তো আন্দোলন করেননি। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দেশের প্রয়োজন সর্বোচ্চ সম্মানী দেওয়া। অন্যদের থেকে আলাদা মান দেওয়া। 

যারা জাতির ভূমিকার সহায়ক হিসেবে কাজ করেন, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষা দেন তাদেরকে আলাদা সম্মানীর সঙ্গে সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া উচিত। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হলে শিক্ষার মানের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানও অগ্রগতি হবে, আধুনিক হবে। যদি শিক্ষকদের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো হয়, তাহলে তারাও শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্নশীল হবেন না। যত্নশীল না হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়বে। তাই সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নিরসনে কাজ করা। শিক্ষক মহোদয়গণের কথা শোনা। শিক্ষকগণেরও উচিত সত্য, ন্যায় ও ন্যায্য কথা বলা।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

/সনি/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়