ঢাকা     রোববার   ০৭ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২৩ ১৪৩১

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের যথাযথ মূল্যায়ন জরুরি

জুবায়েদ মোস্তফা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০২, ৪ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৯:০৩, ৪ জুলাই ২০২৪
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের যথাযথ মূল্যায়ন জরুরি

বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বড় ধরনের মাথা ব্যথার কারণ। ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার সবচেয়ে কার্যকরি সমাধান হলো কারিগরি শিক্ষার প্রসার। কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে একজন মানুষ হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জন করে যোগ্য কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।

উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায়, কারিগরি শিক্ষার চাহিদা আকাশচুম্বী। প্রতি বছরই এ দেশগুলোতে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষ জনশক্তির সংখ্যা এবং দ্রুত সময়ের ব্যবধানে উন্নয়নের হিড়িক পড়েছে। দেশের শিক্ষিত বেকারদের বেকারত্ব দূরীকরণ, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে বর্তমান সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নের দিকে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রায় ২০৫টি। এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিনটি স্তরে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যথা- সার্টিফিকেট স্তর, ডিপ্লোমা স্তর ও ডিগ্রি স্তর। যার মধ্যে সার্টিফিকেট পর্যায়ে সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সংখ্যা ১৪৯টি এবং সেই সঙ্গে বিদ্যমান একটি ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। ডিপ্লোমা পর্যায়ে ৫০টি পলিটেকনিক/মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ডিগ্রি পর্যায়ে একটি টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে।

কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও অধিদপ্তরাধীন প্রতিষ্ঠানে সরকার ২০২১ সালে ২ হাজার ১৮১ জন ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর নিয়োগ প্রদান করে। যাদের যোগ্যতা হিসেবে পদার্থ ও রসায়নসহ দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি এবং কম্পিউটার পরিচালনায় দক্ষতা অথবা উচ্চ মাধ্যমিক (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুই বছরের ট্রেড কোর্স এবং পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা সনদ চাওয়া হয়েছিল। বর্তমানে প্রায় সহস্রাধিক ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর আছেন, যারা ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং/বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করা। এছাড়াও পদার্থ, রসায়ন, গণিত বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী সহস্রাধিক ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরও কর্মরত রয়েছেন।

অবাক করা বিষয় হলো পূর্বের ও নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরগণকে পলিটেকনিক/মনোটেকনিক ইনস্টিটিউটে তাদের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কাজের (ব্যবহারিক ক্লাস পরিচালনার) সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সবচেয়ে বেশি বলির পাঠা হচ্ছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।

ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরগণের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ পলিটেকনিক নন-গেজেটেড টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাপনটিএ) এর দাবি অনুযায়ী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গেজেট, শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন আদেশে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদগুলি নন-গেজেটেড শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ থাকার পরেও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষগণ তাদের ব্যবহারিক ক্লাস পরিচালনায় কোনো দায়িত্ব দিচ্ছে না। তবে কিছু সংখ্যক ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের বিভিন্ন সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে সংযুক্তিতে পদায়নের মাধ্যমে তাদের দিয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক ক্লাস পরিচালনা করছেন। এটা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেও অন্তর্ভূক্ত করা অধিক প্রয়োজন।

সরকার ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরগণের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বগুড়ায় অবস্থিত ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (ভিটিটিআই) অ্যাসেট প্রকল্পের আওতায় এনটিভিকিউএফ লেভেল ১, ২ ও ৩ সনদায়নের জন্য ট্রেনিং ও অ্যাসেসমেন্টের ব্যবস্থা করছে। এ ট্রেনিংয়ে বর্তমানে বিভিন্ন টেকনোলজির সাতটি করে ব্যাচ বিরতিহীনভাবে ট্রেনিং করে যাচ্ছে।

ট্রেনিংয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যারা (প্রায় দেড় সহস্রাধিক) ট্রেনিং নিয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রায় শতভাগই সফলতার সঙ্গে শেষ করে ফাইনাল অ্যাসেসমেন্টে উত্তীর্ণ হয়েছেন। মুদ্রার অপর পিঠ উল্টালে দেখতে পাওয়া যায় হিতের বিপরীত। মানসম্মত সম্মানি ও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে যে উদ্দেশ্যে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, সেটার প্রতিবিম্ব কর্মক্ষেত্রে একবারে অনুপস্থিত। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের যোগ্য ও দক্ষ করার সুবিন্যস্ত কৌশলটাকে পঙ্গু করে।

প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার যে সুন্দর হাতেখড়ি হয়েছে, সেটা ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলার জন্য ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরগণের ক্লাস রুমে যোগদানের কোনো বিকল্প নেই। কর্মক্ষেত্রে তাদেরকে সঠিক পন্থায় কাজে লাগানো হলে প্রতিষ্ঠান এবং ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে। অতীতে বিভিন্ন অফিস অর্ডারে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরগণকে শিক্ষক হিসেবে সম্বোধন করা হতো, কিন্তু বর্তমানে সেটা হচ্ছে না, যা তাদের আত্মসম্মানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কারিগরি শিক্ষা নিয়ে সরকারের যেহেতু সুদূরপ্রসারী চমৎকার পরিকল্পনা রয়েছে, সেহেতু ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের কাজে লাগানো হতে পারে সোনায় সোহাগা। সরকার কারিগরি শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, প্রতিটি জেলায় একটি করে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, প্রতিটি বিভাগে একটি করে মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, প্রতিটি বিভাগে একটি করে মহিলা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক বিপ্লব সাধন হবে, দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রছাত্রী কারিগরি শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে।

এ প্রতিষ্ঠানগুলো চালু হলে প্রচুর জনবলের দরকার হবে। প্রতিটি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে টেক ও নন-টেক ক্যাটাগরিতে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টরের প্রয়োজন হবে। সরকার চাইলে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এক ঢিলে দুই পাখি মারার নীতিতে এগোতে পারে। যারা ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাকগ্রাউন্ডের আছে, তাদেরকে পর্যায়ক্রমে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর (টেক) পদে স্ব-স্ব টেকনোলজিতে এবং যারা পদার্থ, রসায়ন ও গণিত ব্যাকগ্রাউন্ডের আছেন তাদেরকে পর্যায়ক্রমে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর (নন-টেক/পদার্থ/রসায়ন/গণিত) পদে প্রমোশনের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে করে পদটিতে নতুন লোকবল নিয়োগের ঝামেলা কমে যাবে এবং তারাও স্ব-স্ব ব্যাকগ্রাউন্ড অনুযায়ী কাজ করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিজের সেরাটা দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পাবে।

অন্যদিকে সরকারেরও বিশাল বাজেট সাশ্রয়ী হবে। প্রতি মাসে নতুন করে নিয়োগপ্রাপ্ত জনবলকে বেতন দেওয়ার জন্য আলাদা করে চিন্তা করতে হবে না। তাছাড়া খণ্ডকালীন শিক্ষকদের পেছনে সরকার প্রতি মাসে যে বিশাল অর্থ ব্যয় করে সেটারও সাশ্রয় হবে।

ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরগণ যেহেতু সংযুক্তিতে দেশের বিভিন্ন টিএসসিতে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে ২-৩ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োজিত করেছেন, সেখানে তাদের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। ৩০-৩৫ বছর কারিগরি সেক্টরে নিজেকে সঁপে দেওয়ার পর না পাওয়ার যাঁতাকলে অশ্রুসিক্ত বিদায় নেওয়ার ঘটনা রয়েছে। তাই এ রকম হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য যেন পরবর্তীতে মঞ্চায়িত না হয়। সবকিছু বিবেচনায় তাদেরকে পদোন্নতি দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠানে যথাযথ মূল্যায়ন করা জরুরি।

লেখক: শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়