ঢাকা     রোববার   ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ||  চৈত্র ৩০ ১৪৩১

জাবিতে মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা, প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ

জাবি সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৫, ১৫ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ২০:১৯, ১৫ জুলাই ২০২৪
জাবিতে মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা, প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ

কোটা সংস্কার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটেছে। রোববার (১৪ জুলাই) রাতে এ হামলার ঘটনা ঘটে।

এতে আন্দোলনকারীদের চারজনসহ অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টার ও এনাম মেডিক্যালে প্রেরণ করা হয়।

এদিকে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার পদত্যাগ করেছেন।

জানা গেছে, রোববার রাত ৯টার দিকে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে জেরা ও মোবাইল ফোন চেক করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় হল প্রাধ্যক্ষকে জবাবদিহিতার জন্য ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিতের দাবিতে দিবাগত রাত ৩টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল প্রদক্ষিণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল সংলগ্ন সড়কে প্রবেশ করতে যায়। এসময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের উপর হামলা করে। এতে আন্দোলনকারীদের চারজনসহ অন্তত পাঁচজন আহত হন।

আহতরা শিক্ষার্থীরা হলেন, আহসান লাবিব, সোহাগী সামিয়া, তৌহিদ সিয়াম ও মেহরাব সিফাত। এছাড়া আরও একজন নিরাপত্তা কর্মী আহত হন। তবে তার নাম জানা যায়নি।

এদের মধ্যে আহসান লাবিবকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে এবং সোহাগী সামিয়াকে এনাম মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।

হামলার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী প্রাচুর্যসহ বেশ কয়েকজন হামলা করেন। এছাড়া এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. আর রাফি চৌধুরী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল্লাহর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের হলেও এমন স্লোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করেন কিছু শিক্ষার্থী। তারপর স্লোগান পুরো হলে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা সমস্বরে স্লোগান দিতে শুরু করলে হলের ‘পলিটিক্যাল ব্লক’ থেকে কয়েকজন সিনিয়র এসে তাদের সবাইকে ডেকে ডাইনিংয়ে আসতে বলেন।

সেখানে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং ‘শিবির’ সন্দেহে মোবাইল ফোন নিয়ে মেসেঞ্জার চেক করা হয়। দীর্ঘসময় পর্যন্ত ডাইনিং হল থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পান হলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা। পরে সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে তাদেরকে স্লোগানের জন্য ক্ষমা চাইতে বলা হয়। ছাত্রলীগের নেতারা এ সময় হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদারকে সেখানে নিয়ে আসেন। প্রাধ্যক্ষের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে ক্ষমা চান। এরপর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

প্রাধ্যক্ষকে এ ঘটনার জবাবদিহিতার জন্য রাত পৌনে ১২টার দিকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ওই হলের সামনে অবস্থান নেন। এসময় আন্দোলনকারীরা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিতের জন্য বারবার তাগাদা দিলেও হল প্রাধ্যক্ষ বরাবরই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হোসেন তালুকদারকে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আলোচনায় বসতে দেখা যায়। 

এর কিছুক্ষণ পর রাত আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে পুনরায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে আসলে মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের বাধা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর কবিরসহ কয়েকজন শিক্ষক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উভয়ই পক্ষকে থামানোর চেষ্টা করেন।

তবে প্রক্টর ও শিক্ষকদের প্রচেষ্টার তোয়াক্কা না করেই ছাত্রলীগের কর্মীরা বাধা প্রদান করতেই থাকে এবং শিক্ষার্থীদের ‘জামায়াত-শিবির’ আখ্যা দেওয়াসহ  নারী শিক্ষার্থীদের অশ্লীল কথাবার্তা বলেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং সেটা হাতাহাতিতে গড়ায়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেন আন্দোলকারীরা। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলে ঢুকে গেটে তালা আটকে দেয়। পরে তারা ছাদে গিয়ে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়েন বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের।

এদিকে হল প্রাধ্যক্ষ আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উস্কে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় প্রাধ্যক্ষকে ঘিরে এ ঘটনার জবাবদিহিতা চান তারা। তবে এ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার ‘আমি পদত্যাগ করলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপকার হবে’ এমন মন্তব্য করে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেন।

ঘটনার বিষয়ে জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের সামনে বিক্ষোভ মিছিল শেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে এসে উপস্থিত হই। এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের হল গেটে যেতে বাধা দেয়। আমরা শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে নিলে আমায় সামনে থেকে প্রথমে মাথায় ঘুষি দেওয়া হয়। পরে আমার বুকেও আঘাত করে তারা। এতে করে আমি মাটিতে পড়ে যাই এবং আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পরে আমি ক্যাম্পাস মেডিক্যালে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করি।

আরেক ভুক্তভোগী নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৫১ ব্যাচের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, আমরা যখন হলগেট থেকে ফিরে এসে ফাঁকা স্থানে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন হলের ছাদ থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। এই সময়ই একটা ইটের ভাঙা অর্ধেক অংশ আমার পায়ের উপর এসে পড়ে। পরে আমাকে মেডিক্যালে নিয়ে আসা হয়।

তবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে শাখা ছাত্রলীগের অর্থ সম্পাদক ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তৌহিদুল আলম তাকিদ বলেন, আন্দোলনকারীরা আমাদের হলের সামনে এসে কোটা আন্দোলনের নামে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগকে অবমাননা করে স্লোগান দিচ্ছিল। তখন আমরা একটা শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে যেতে চাইলে তারা বাধা দেন এবং গালিগালাজ করেন। তাদের ওপর কোনো হামলা করিনি, যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছি। আমরা হলে ফিরে যাওয়ার সময় তারাই আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে।

ঘটনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মোস্তফা ফিরোজসহ প্রশাসনের পক্ষে কয়েকজন শিক্ষক ঘটনস্থল পরিদর্শনে আসেন। এ সময় উপ-উপাচার্য তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং সকাল ১১টায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ বসবেন বলে আশ্বস্ত করেন। পরে ভোর পৌনে ৫টায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান।

/আহসান/মেহেদী/

ঘটনাপ্রবাহ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়