ঢাকা     মঙ্গলবার   ২২ এপ্রিল ২০২৫ ||  বৈশাখ ৯ ১৪৩২

উত্তপ্ত জাবি, থমথমে পরিবেশ

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৭, ১৬ জুলাই ২০২৪  
উত্তপ্ত জাবি, থমথমে পরিবেশ

ঢাকার সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। সোমবার রাতের সংঘাতের ঘটনাসহ কোটার বিরোধীতায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে উত্তপ্ত পরিবেশ। এদিকে এ আন্দোলনের রেশ ছড়িয়েছে আশপাশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও। জাবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আশপাশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মহাসড়ক অবরোধ ও মিছিল করেন।

মঙ্গলবার সকাল থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা ও বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনেসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

এর আগে, সোমবার মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে সংঘাতের ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

বেলা ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জড়ো হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এরপর তারা হেঁটে যান ডেইরি গেটে। দুপুর ১টার দিকে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মহাসড়কের আরিচাগামী লেন হয়ে হেঁটে ২০ মাইল গেট দিয়ে আবার শহিদ মিনারে এসে জড়ো হন। বেলা ২টার দিকে কোটার বিরোধী শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে ডেইরি গেট ও অপর অংশকে শহিদ মিনারে অবস্থান নিয়ে থাকতে দেখা যায়। বিকেল ৩টার দিকে তাদের ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ, পদযাত্রা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বিরোধীদের ওপর হামলার জেরে সাভারের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে আসে। জাবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জাবি অভিমুখে পদযাত্রা করে বেসরকারি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থীরা। এর জেরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বাইশমাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।

বেলা সাড়ে ১১টা থেকে আশুলিয়ার নলামে অবস্থিত গণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে পদযাত্রা শুরু করে গবি শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বাইশমাইল বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ সড়ক অবরোধ করে মিছিল করে জাবি অভিমুখে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করে তারা। দুপুর পৌনে ১টার দিকে তাদের নবীনগর ত্রিমোড় এলাকায় মিছিল নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায়।

আন্দোলনে অবস্থানরত গবির এক শিক্ষার্থী জানান, গত রাতে ঢাবি-জাবি সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ওপর ছাত্রলীগের বর্বোরচিত হামলার প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ মিছিল। জাবি থেকে বাকি শিক্ষার্থীদের সমন্বয় করে বাকি কর্মসূচি চালানো হবে।

এদিকে সারাদেশে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা এবং কোটা সংস্কারের দাবিতে সকাল ১১টা থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নয়ারহাটে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল অ্যান্ড রিসার্চের (নিটার) পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী মহাসড়ক অবরোধ করে।

এছাড়া ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ধামরাই ঢুলিভিটা এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়ে কোটা সংস্কার ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানায় উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

বেলা আড়াইটার দিকে আশুলিয়ার গণ বিশ্ববিদ্যালয়, মির্জা গোলাম হাফিজ কলেজ, দেওয়ান ইদ্রিস কলেজসহ বেশ কিছু স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে এসে জাবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে সংহতি জানায়।

জাবিতে যা ঘটেছিল গতরাতে

সোমবার সন্ধ্যার দিকে ক্যাম্পাসের বটতলা এলাকায় কোটা আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। রাত ৯টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপাচার্য ওই হামলার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে বিচারের আশ্বাস দেন। তবে তাতে আশ্বস্ত না হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এরইমধ্যে মধ্যরাতে ভিসির বাসভবনের সামনে আসেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আসেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।

রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে পুলিশ একটি জলকামান নিয়ে আসে। মঙ্গলবার ভোর ৪টার দিকে পুলিশ জলকামান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ও ছররা গুলি ছুড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় চিকিৎসাকেন্দ্রের সামনেও শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ারশেল ছোড়ে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত দুইজন শিক্ষক ও সাতজন সাংবাদিক আহত হন। চোখে ছররা গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়েছেন এক শিক্ষক। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর গুরুতর আহত ব্যক্তিদের সাভারের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

আহত শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব মাহফুজ ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রলীগের সভাপতির নেতৃত্বে আক্রমণাত্মক হয়ে আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা করা হয়েছে। তারা আমাদের হত্যাচেষ্টা করেছে। আমাদের কাদার মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। এলোপাতাড়ি লাথি দিয়েছে। লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে।’

ওই সংঘাতে আহত ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মাফরুহি সাত্তার জানান, ‘উপাচার্যের বাসার সামনের বারান্দায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছিলেন। হামলা থেকে রক্ষা পেতে তারা চেয়ার দিয়ে ঢাল তৈরি করেছিলেন। যখন তাদের ওপর হামলা হয়, তখন পুলিশের কয়েকজন সদস্য হামলাকারীদের ধাওয়া দেন। ইটপাটকেল ও পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের সেলে সেখানে চার-পাঁচজন শিক্ষক আহত হয়েছেন। আমি মাথায় আঘাত পেয়েছি।’ 

এ বিষয়ে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান মোতাহার হোসেন বলেন, ‘ওই শিক্ষকের শরীরে ও ডান চোখে ছররা গুলি লেগেছে। চোখের অবস্থা ভালো না। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’

হামলার বিষয়টি অস্বীকার করে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘আমরা কোনো ধরনের হামলা করিনি। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তারা আমাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়েছে। এতে আমাদের কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন। ক্যাম্পাসে অন্যায্য কোনো কিছু ঘটলে আমরা শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করব।’

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ঢাকা দক্ষিণ (ক্রাইম এন্ড অবস) আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন হচ্ছিল। তাদের দাবি দাওয়া বাংলাদেশ সরকার ভালোভাবে নিয়ে বিবেচনা করে দেখছে। বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছে। হঠাৎ করে কিছু দুষ্কৃতকারী এখানে দেখেছেন জাবি ভিসির বাসায় গতরাত সাড়ে ৩টার দিকে অতর্কিত হামলা করে। সেখানে পুলিশ সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সাংবাদিক ভাইরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখানে এসে এটি প্রতিহত করে। এরপর তারা এখান থেকে সরে যায়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি পুরোটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।’

তিনি বলেন, ‘যারা আইন হাতে তুলে নিয়েছে, উপাচার্যের বাংলোতে আক্রমণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ঢাকা জেলা পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যারা এখানে অতর্কিতভাবে হামলা করেছে, তাদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। হঠাৎ করে এসে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে অশান্ত করে এসব করেছে, বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। তাদের বের করে তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ গ্রেফতার ও যা যা করণীয় সেটা আমরা পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

/আরিফুল/মেহেদী/

ঘটনাপ্রবাহ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়