ঢাকা     বুধবার   ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ||  মাঘ ২ ১৪৩১

জবির ‘আয়নাঘর’র হোতা কাজী মনিরকে বরখাস্তের দাবি

জবি সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ১৪ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ২৩:০২, ১৪ আগস্ট ২০২৪
জবির ‘আয়নাঘর’র হোতা কাজী মনিরকে বরখাস্তের দাবি

কর্মকর্তা কমিতির সভাপতি আব্দুল কাদের ওরফে কাজী মনির

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) কথিত ‘আয়নাঘর’র হোতা কর্মকর্তা কমিতির সভাপতি আব্দুল কাদের ওরফে কাজী মনিরকে চাকরি থেকে বরখাস্তের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আটকে রেখে নির্যাতন ও হয়রানি, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলা, আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের হুমকি, বিভিন্ন প্রকল্পে লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্ত করে উপযুক্ত বিচারের দাবিও জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

বুধবার (১৪ আগস্ট) ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আয়োজিত এক বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থীরা এ দাবি জানান ।

সভাকক্ষে উপস্থিত ছিলেন জবি কোষাধ্যক্ষ, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান ও ছাত্র উপদেষ্টারা। সমন্বয়কদের মধ্যে নূরনবী হোসেন, মো. সোহান,ইভান তওসিভ, বাপ্পী হোসেনসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

জবির কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি আব্দুল কাদের ওরফে কাজী মনির বর্তমানে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের রিপন-সাঈদ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন বলে জানা গেছে। 

শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ২০১৬ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রক্টর অফিসে ধরে নিয়ে নির্যাতন করতেন তিনি। সে সময় কাজী মনির প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি প্রক্টর অফিসকে অঘোষিত ‘আয়নাঘর’ বানিয়ে রেখেছিলেন। তার দুর্নীতি, অপকর্ম নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ হলেও প্রতিবারই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা না নিয়ে নিষ্ক্রিয় থেকেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও শিক্ষকের ছত্রছায়ায় তিনি এসব অপকর্ম করেছেন।

প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও হল আন্দোলনের নেতা সাজ্জাদ হোসেন মুন্না অভিযোগ করে বলেন, ২০১৬ সালে হল আন্দোলনের সময় কাজী মনির আমাকে ক্যাম্পাসে সবার সামনে গলা চেপে ধরেছিলেন। পরে প্রক্টর অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে হয়রানি করেন। সেই সময় অনেক শিক্ষার্থীকে নির্যাতনও করেন। ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনেও তিনি শিক্ষার্থীদের হমকি-ধামকি দিয়েছিলেন। এবার আমাদের ওপর হামলাও করতে এসেছিলেন এবং আমাদের ক্যাম্পাস ছাড়া করার হুমকিও দিয়েছেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে হামলা ও হুমকি

কোটাবিরোধী আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের সরাসরি ও অনলাইনে কাজী মনিরসহ তার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী হুমকি-ধামকি দেন বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এছাড়া গত ১৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর ক্যাম্পাসে তাকে ও তার দলবদ্ধ লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করতেও দেখা গেছে। পরে কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের নিবৃত করে নিয়ে যান। ওই সময় কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ছাড়া করার হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট ক্যাম্পাসে আয়োজিত মানববন্ধনে কোটা আন্দোলনকারীদের জামায়ত-শিবিরের এজেন্ট বলে তাদেরকে মারধর ও ক্যাম্পাস ছাড়া করার হুমকি দেন।

এদিকে, আব্দুল কাদের ওরফে কাজী মনির ও তার সহযোগী অন্যান্য কর্মকর্তারা গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই আত্মগোপনে চলে গেছেন। এরপর আর ক্যাম্পাসেও দেখা যায়নি তাকে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলেও কাজী মনির ও তার সহযোগীরা ক্যাম্পাসেও আসছেন না।

টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্য এবং চাঁদাবাজির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ

অভিযোগে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব টেন্ডারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কাজী মনিরের হাতে। সব টেন্ডারে নির্দিষ্ট কমিশন গ্রহণ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগও নিয়ন্ত্রণ করে তার নেতৃত্বে থাকা অঘোষিত সিন্ডিকেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী কয়েকজন কর্মকর্তা ও শিক্ষকের যোগসাজশে এ সিন্ডিকেট পরিচালিত হয় বলে জানা গেছে।

ক্যাম্পাসের সামনে থাকা সদরঘাটগামী বাস ব্যবসার সঙ্গে রয়েছে তার প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা। দৈনিক ও মাসিক ভিত্তিতে তিনি বাস স্ট্যান্ড, লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা উত্তোলন করেন। শিক্ষার্থীদের বিরোধীতা সত্ত্বেও তার প্রভাবের কারণে ক্যাম্পাসের সামনে থেকে অবৈধ বাস স্ট্যান্ড সরানো যাচ্ছে না। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বিশ্বিবদ্যালয়ের সামনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সদরঘাট, ইসলামপুরের কাপড়ের দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নিজেকে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকা একটি ছবি দেখিয়ে তিনি এসব অপকর্ম করেন বলে জানা গেছে।

দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্পে লুটপাট

বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের ভূমি অধিগ্রহণ, সীমানা প্রাচীর নির্মাণে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রযেছে তার বিরুদ্ধে। প্রাচীর নির্মাণের সময় জমি বেহাত করে অর্থ লুটের জন্য কাজী মনিরের নেতৃত্বে গড়ে উঠে একটি অসাধু চক্র। এ চক্রে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি কর্মকর্তা কামাল হোসেন সরকার, নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পের কয়েকজন কর্মকর্তার নামও উঠে এসেছে। তাদের সাথে কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিও জড়িত।

অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী এই চক্রের প্রশ্রয়দাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ। এটি নিয়ে সংবাদও প্রকাশ হয়েছিল বিভিন্ন গণমাধ্যম। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিলেও তার প্রভাবের কারণে প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়াও নতুন ক্যাম্পাসের নলকূপ স্থাপনের অর্থও আত্মসাৎ করেন কাজী মনির। নতুন ক্যাম্পাসের অধিগ্রহণকৃত জমি অবৈধভাবে দখল করে মাছ চাষ, মাটি বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এটি নিয়েও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তদন্ত কমিটি গঠিন হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের হেনস্তা ও নির্যাতন

২০১৬ সালে হল আন্দোলনের সময় প্রক্টর দপ্তরে সেকশন অফিসার হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালে কাজী মনির শিক্ষার্থীদের প্রক্টর অফিসে ধরে নিয়ে শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন করতেন ও পুলিশে দিতেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করতেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককেও শারীরিকভাবে হেনস্তার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে কাজী মনিরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার মোবাইল নম্বরে কয়েকবার কল দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

/লিমন/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়