জাবি উপাচার্য হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে যারা
আহসান হাবীব, জাবি || রাইজিংবিডি.কম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর গত ৭ আগস্ট পদত্যাগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম। এছাড়া উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), উপ-উপাচার্য (প্রশাসন), রেজিস্ট্রার, কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টর পদে থাকা আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরাও পদত্যাগ করেছেন। উপাচার্যসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূণ্য থাকায় থমকে আছে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম।
এর আগে, গত ১১ আগস্ট থেকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দেওয়া হলেও শীর্ষ পদগুলো শূন্য থাকায় স্বাভাবিক হয়নি শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ সময়ের দাবি।
এরই মধ্যে নতুন উপাচার্য পদে আলোচনায় রয়েছে ১০ শিক্ষকের নাম। এছাড়া তালিকায় অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন শিক্ষকের নামও রয়েছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। তবে অবসরপ্রাপ্তদের উপাচার্য হিসেবে চান না বলে জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা শিক্ষক হিসেবে সৎ, প্রশাসক হিসেবে দক্ষ ও যোগ্য, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া পূরণে সমর্থ একজন ব্যক্তি যেন উপাচার্য নির্বাচিত হন। নতুন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে সর্বোচ্চ নজর দেবেন বলেও প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন উপাচার্য চান জানতে চাইলে দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী আমিরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে এমন একজন সৎ, যোগ্য ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষককে চাই। যিনি সব ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন। আধুনিক, নিরাপদ, সবুজ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত এক সুন্দর ক্যাম্পাস আমাদের উপহার দিতে পারবেন- এমন একজন দক্ষ, নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন শিক্ষককেই আমরা উপাচার্য হিসেবে দেখতে চাই।
উপাচার্য পদ পেতে আলোচনায় যারা
জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর ১১(১) ধারা অনুযায়ী উপাচার্য পদে সিনেটে সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে তিন সদস্যের প্যানেল নির্বাচন করা হয়। সেই প্যানেল থেকে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য যে কোনো একজনকে চার বছরের জন্য নির্ধারিত শর্তাবলি সাপেক্ষে নিয়োগ দেন। একই ব্যক্তি এই পদে পুনরায় আরও চার বছর দায়িত্ব পালনের যোগ্য হবেন। এছাড়া অ্যাক্টের ১১(২) ধারা অনুসারে যদি ছুটি, অসুস্থতা, পদত্যাগ বা অন্য কোনো কারণে উপাচার্যের পদে শূন্য হলে আচার্য উক্ত পদে দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করবেন। তবে রেজিস্ট্রার না থাকায় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের সুযোগ নেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে নতুন উপাচার্য হিসেবে আলোচনায় এসেছে আট শিক্ষকের নাম। যেহেতু প্যানেল নির্বাচনের সুযোগ নেই, তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাকে যোগ্য মনে করবেন, তাকেই এ পদে নিয়োগ দেবেন বলে জানা গেছে। তবে এ তালিকায় প্রাধান্য পাবে শিক্ষার্থীদের পছন্দ। অন্যথায় ফের আন্দোলনের আভাস রয়েছে।
আলোচনায় থাকা শিক্ষকরা হলেন- প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সোহেল আহমেদ, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান, ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দীন রুনু, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামছুল আলম, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা এবং গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের ডিন আব্দুর রব। এদের মধ্যে সোহেল আহমেদ আওয়ামীপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। আর গোলাম রব্বানী ব্যতীত বাকিরা বিএনপিপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত।
সবচেয়ে আলোচিত প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বর্তমানে শিক্ষক সমিতির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষ ও বিভাগীয় সভাপতিসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তিনি ৪৫টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলনে সব সময় ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশে। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনেও শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে দেখা গেছে তাকে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন এবং কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালে ফ্রন্ট লাইনার হিসেবে কাজ করেছেন।
দর্শন বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত হলেও যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে সুনাম ও আস্থা কুড়িয়েছেন। তিনি শিক্ষকদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের জাবি শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনীতির পাশাপাশি অ্যাকাডেমিক ও টক-শো ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, জাবি শিক্ষক সমিতির সম্পাদকসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, হল প্রাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেছেন।
ফার্মেসী বিভাগের অধ্যাপক মাফরুহি সাত্তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। পাশাপাশি তিনি শিক্ষক সমিতির সম্পাদক, প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষ, বিভাগীয় সভাপতিসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ জার্নাল অফ লাইফ সায়েন্সের সম্পাদকীয় বোর্ডে ছিলেন। তিনি এডি সায়েন্টিফিক ইনডেক্স র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশে ৭৮তম স্থান অর্জন করেছেন। এছাড়া যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষার্থীদের পাশে তাকে দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন রুনু নির্বাচিত সিনেট সদস্য, প্রকৃতি সংরক্ষণ উদ্যোগ ফোরামের উপদেষ্টা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতিসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ১৯টি গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছেন। যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশে তাকেও দেখা গেছে।
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী জাবির একই বিভাগ থেকে বিএ (অনার্স), এমএ, এমফিল করেন। পরে নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক ইতিহাস (মধ্যযুগীয়), বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, বাংলাদেশের উত্থান এবং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে পড়ান। তিনি বর্তমানে নির্বাচিত সিনেটর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য। এছাড়া তিনি জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের সহ-সভাপতি, আনন্দনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও উপদেষ্টা এবং রোটারাক্ট ক্লাব অফ জাহাঙ্গীরনগরের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়া আলোচনায় আছেন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষ, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সভাপতি, পরিবহন অফিসের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক, উচ্চ শিক্ষা কমিটির সভাপতি, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য এবং নির্বাচিত সিনেটর ও সিন্ডিকেট সদস্যসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। যে কোন যৌক্তিক আন্দোলনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশেও থেকেছেন। এছাড়া তার অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে।
আলোচনায় রয়েছেন শামীমা সুলতানা নামে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বিভাগের কার্যালয় থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে ফেলে তিনি বেশ আলোচিত-সমালোচিত হন। অধ্যাপক শামীমার ১৪টি গবেষণা প্রবন্ধ এবং একটি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়া হল প্রাধ্যক্ষ, ওয়ার্ডেনসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি সিনেটের নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধিও।
আলোচনায় থাকা অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক। তিনি যুক্তরাজ্যের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি জলবিদ্যা, চ্যানেল ফর্ম, গতিবিদ্যা, প্লাবনভূমি, জলবিভাজিকা ব্যবস্থাপনা, ভৌগলিক তথ্য ব্যবস্থা (জিআইএস) গবেষণা পদ্ধতি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়ান। তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন।
এছাড়া অধ্যাপক মুহম্মদ নজরুল ইসলাম গণিত বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। এমএসসিতে ৭৫ শতাংশের বেশি নম্বর অর্জনের জন্য শরফুদ্দিন স্বর্ণপদক পেয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন।
এদিকে অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন অধ্যাপকের নামও আলোচনায় উঠেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, আমির হোসেন প্রমুখ। তবে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের উপাচার্য হিসেবে চান না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ।
গত ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীর হামলায় আহত শিক্ষক অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতামত দিতে গিয়ে জানান, অবসরপ্রাপ্তদের উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ওইসব উপাচার্যদের কোনো দায়িত্ববোধ থাকে না। কেননা তাদের মেয়াদ শেষ হলেই তারা শিক্ষকদের মধ্যে আর ফিরে আসবেন না। ফলে দুর্নীতি, লুটপাট আর নিয়োগ বাণিজ্যের দিকেই তাদের মনোযোগ থাকে। আবার একজনকে একাধিকবার দায়িত্ব দেওয়ায় তারা যেমন স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন, তেমনি স্বৈরাচারী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে দুর্নীতির বলয়কে আরও প্রশস্ত করে তোলেন। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসরপ্রাপ্তদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব না দেওয়াই শ্রেয়।
/মেহেদী/