বাকৃবির এক হলেই ছাত্রলীগের ৭ লাখ টাকার সিট বাণিজ্য
লিখন ইসলাম, বাকৃবি || রাইজিংবিডি.কম

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলে ছাত্রলীগের সিট বাণিজ্য নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও (বাকৃবি) এর ব্যতিক্রম ছিল না। সিট বাণিজ্যের কথা ভয়ে কেউ স্বীকার করেননি এতদিন। ছাত্রলীগের কাছে এক রকম জিম্মি হয়েই থাকতে হতো ভুক্তভোগীদের।
স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর ভুক্তভোগীরা এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। কোন নেতাকে কত টাকা দিয়ে হলে একটি সিট পেয়েছেন, তার নাম উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ফজলুল হক হলে থাকা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
হল সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের আয়ের প্রধান দুটি উৎস হলো- আবাসিক হলের ডাইনিং ও সিট বাণিজ্য। মূলত অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা মাস্টার্স করতে আসেন, তাদের থেকেই টাকা নিয়ে সিট দেওয়া হয়। অনেক সময় হলের নেতাদের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় দুবারও টাকা দিয়ে হলে থাকতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। শুধু তাই নয়, বাকৃবির শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষ অতিক্রম করে হলে উঠতে চাইলে, তাদের থেকেও নেওয়া হয়েছে টাকা। মাথাপিছু ১০ হাজার থেকে শুরু করে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্তও নেওয়া হয়েছে। যারা লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছেন, তাদের টাকা হিসেব করে দেখা গেছে গত বছর শুধু ফজলুল হক হলেই মোট ৭ লাখ ৮ হাজার টাকার সিট বাণিজ্য হয়েছে। সবার তথ্য পেলে টাকার অংক সেটা সহজেই অনুমেয়। বিশ্ববিদ্যালয় এখনও অফিসিয়ালি খুলে না দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা সবাই হলে নেই। ফলে সিংহভাগ শিক্ষার্থীরা হিসেবে বাহিরে রয়েছেন।
লিখিত অভিযোগে ফজলুল হক হলে সিট বাণিজ্যে জড়িত বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেন ভুক্তভোগীরা। এর মধ্যে রয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না পাওয়া শিক্ষার্থী শেখ মেহেদী রুমি জয়, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী এএইচএম হেলালুজ্জামান (ডন), মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিব, খান মোহাম্মদ হাসনাইন কবির, আরিফুল ইসলাম সাগর ও মো. মজনু রানা।
২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মহব্বত আলী জানান, প্রথমে আমি হলে উঠেছিলাম। কিন্তু গেস্ট রুমের অত্যাচারে হল ছাড়ি। তারপর হলে উঠার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাকে বাধা দেয়। হলের প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে টাকা ছাড়া হলে সিট দিতে পারবেন না বলে জানান। এরপর ফজলুল হক হলের ছাত্রলীগ নেতা হেলাল এবং রাকিবকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে হলে উঠি। আমার সঙ্গে যারা উঠেছেন, তারা ১০-১২ হাজার টাকা দিয়ে উঠেছে। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র, কেনো আমাকে টাকা দিয়ে উঠতে হবে? আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
২০১৭-১৮ বর্ষের শিক্ষার্থী আকিবুল ইসলাম জানান, আমি প্রথমে হলে উঠলেও ছাত্রলীগের অত্যাচারের কারণে বাহিরে চার বছর থাকি। পরে আর্থিক দুরবস্থার কারণে হলে উঠার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাকে উঠতে দেয়নি। এরপর আমি এইচএম হেলাল উদ্দিনকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা দিয়ে হলে উঠি। হলের একজন আবাসিক ছাত্র হয়ে কেনো আমাকে টাকা দিতে হবে? আমি এর বিচার চাই। পরবর্তী কেউ যেন এ ধরনের সিস্টেমের শিকার না হয়, তার নিশ্চয়তা চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আল-আমিন বলেন, প্রথম বর্ষে শুরুতে হলে উঠলেও ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে হল ছেড়ে দিয়ে দুই বছর বাইরে ছিলাম। কিন্তু আমার বাবা একজন গার্মেন্টস কর্মী। তার পক্ষে হলের বাইরে থাকতে যে খরচ, তা বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ জন্য ফজলুল হক হলের ছাত্রলীগ নেতা এএইচএম হেলালুজ্জামান ডন ও রাকিবুল ইসলামকে বললে তারা ১২ হাজার টাকার বিনিময়ে আমাকে হলে সিট দেন। পরিপূর্ণ আবাসিক হল হওয়া সত্ত্বেও আমাকে টাকা দিয়ে হলে উঠতে হয়েছে, যা অত্যন্ত লজ্জার ও নেক্কারজনক।
ভেটেরিনারি অনুষদের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রায়হান হৃদয় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হলে উঠলে ছাত্রলীগের প্রেশারের কারণে আমি ওই হল ত্যাগ করি। প্রায় ২ বছর আমি হলের বাইরে ছিলাম। এভাবে হলের বাইরে থাকা আমার অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। পরে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফজলুল হক হলে ওঠার চেষ্টা করি। ফজলুল হক হলের ছাত্রলীগ নেতা এএইচএম হেলালুজ্জামান ডন ও রাকিবুল ইসলাম আমার থেকে টাকা নিয়ে হলে উঠায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে টাকা নিয়ে আমার অনেক বন্ধুদেরও হলে তোলেন তারা। আমি ও আমার বন্ধুদের থেকে ১০ হাজার বা তার বেশি টাকা নিয়েছেন তারা। আমার মতো ভুক্তভোগী যাতে আর কেউ না হয়, সে জন্য আমি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
অভিযুক্ত এএইচএম হেলালুজ্জামান বলেন, হলে সিট বাণিজ্যের বিষয়টি ছিল, এটা সবারই জানা। এ বিষয়টি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমরা যারা হলের ছাত্রলীগ কর্মী ছিলাম, তারা কেবল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদকের মাধ্যম ছিলাম। সিট বাণিজ্যের এ টাকা আমরা কেউই নিতাম না। আমরা কেবল মাধ্যম ছিলাম।
অভিযুক্ত আরিফুল ইসলাম সাগর বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। এসব অভিযোগ কারা দিচ্ছেন, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। হলের সিটের জন্য টাকা নেওয়ার ব্যাপারে আমি অবগত নই। সিট বাণিজ্যের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নাই। হয়তো ছাত্রলীগ পদধারী হওয়ার কারণে আমার নামে এ সব অভিযোগ দিচ্ছেন তারা।
সিট বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে রাকিবুল ইসলাম বলেন, এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। সিট বাণিজ্যের সঙ্গে আমি কখনোই যুক্ত ছিলাম না। আমি হলের একদম সিনিয়র প্রতিনিধি ছিলাম। সে কারণেই হয়ত কেউ মনের ক্ষোভ থেকে আমার নাম দিয়েছেন।
তবে বাকি অভিযুক্তদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
/মেহেদী/