ঢাকা     শনিবার   ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ৩০ ১৪৩১

‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামের স্বার্থকতা পেতে যা প্রয়োজন

মো. মশিউর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৪৮, ২৯ আগস্ট ২০২৪  
‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামের স্বার্থকতা পেতে যা প্রয়োজন

‘শিক্ষাই আলো’ ও ‘সত্যের জয় সুনিশ্চিত’- স্লোগান ও নীতিবাক্য ধারণ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যুগ যুগ ধরে পরিচিত মুক্ত চিন্তার আঁতুড়ঘর এবং জ্ঞান, বিজ্ঞানে গবেষণা ও দেশ পরিচালনার অগ্রগামী সৈনিক হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর বিভিন্ন পট পরিবর্তন ও দেশের কল্যাণে অজস্র ত্যাগ তিতিক্ষার সাক্ষী।

পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণ অথবা যে কোনো স্বৈরশাসকের দাবানলের অগ্নি সর্বপ্রথম ধেয়ে এসেছে ঢাবির দিকেই। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি হানাদার এবং দেশীয় স্বৈরশাসকরা একটা জায়গায় দারুণ অনুমান করেছেন। ঢাবিকে দমিয়ে রাখা গেলেই বোধহয় সারা বাংলাদেশ দমিয়ে রাখা সম্ভব।

বাংলাদেশের সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে অনেকটা সফল হলেও তার পতনের শুরুর গল্পের সূচনা এখান থেকেই। ঢাবিকে দমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ব্যবহার করেছেন কিছু পুরনো ও নতুন পদ্ধতি। তিনি প্রথমত আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছেন অনেকটা প্যারামিলিশিয়া বাহিনী হিসেবে। ঢাবির প্রতিটি হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করে ছাত্রলীগ তার সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। ঢাবির হলে হলে গণরুম ও গেস্টরুম প্রথা চালু করে পড়াশোনার পরিবেশ ব্যাহত করেছে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের মতে, প্রতিটা গেস্টরুম বা টর্চার সেল এক একটি ‘আয়নাঘর’।

বেশিরভাগ হলের তথ্য মতে, সপ্তাহে তিনদিন থেকে চারদিন প্রতিদিন অন্তত ৩-৪ ঘণ্টা সময় দিতে হতো এই গেস্টরুমে। সেখানে সাধারণত মারধর করা না হলেও কখনো কখনো কেউ সালাম দিয়ে ভুল করা বা ছাত্রলীগের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ না করার জন্য যেতে হতো সিঙ্গেল গেস্টরুমে। এটাই মূলত টর্চার সেল; যেখানে স্ট্যাম্প, রড দিয়ে শারীরিক ও বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন চালানো হতো। যারা এই টর্চার সেলের মধ্য দিয়ে গেছেন, তারা পরবর্তীতে অনেকেই মানসিক ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি।

ছাত্রলীগের নির্যাতন হতো অনেকটা সাংগঠনিক আকারে। তারা নির্যাতনের জন্য তৈরি করেছিল বেশ শক্তিশালী চেইন অব কমান্ড। হলের রুম দখল ও সিট বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তঃকোন্দল থাকলেও জুনিয়রদের ভয়ভীতি দেখানোর ক্ষেত্রে তারা ছিল বেশ সংঘবদ্ধ। মাঝে মধ্যে নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের খবর সংবাদমাধ্যমে আসলেও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের আজ্ঞাবহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতো। প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিনদিন বাধ্যতামূলক ছাত্রলীগের কর্মসূচীতে হলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করতে হতো। এ ক্ষেত্রে কোনো ফাঁকিবাজি পাওয়া গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেওয়া হতো টর্চার সেলে।

ছাত্রলীগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে শেখ হাসিনা তৈরি করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতি শিক্ষার্থীদের এক ভীতির চক্র। আর এই ভীতি তৈরি করে ছাত্রলীগ পেয়েছিল চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের অবাধ স্বাধীনতা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মেডিকেল মোড়, শাহবাগ, নীলক্ষেত, পলাশী থেকে আসা চাঁদার ভাগ পেত ছাত্রলীগ নেতা থেকে শুরু করে তাদের আশ্রয় দেওয়া আওয়ামী লীগ নেতারাও।

এ পুরনো পদ্ধতি ব্যবহারের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সেক্টরে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন চালিয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক উইং, ডিবেটিং সোসাইটি, টিএসসি কেন্দ্রীক অন্যান্য সংগঠনও নিজেদের দখলে নিয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে চাকরি দিতে প্রশাসনকে বাধ্য করেছে।

এ ধরনের পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে ঢাবির শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বাক-স্বাধীনতা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের খাবারের ক্যান্টিনে পর্যন্ত ছাত্রলীগ দখলদারি দেখিয়েছে। তাদের ট্যাগের রাজনীতির কারণে অসংখ্য অসহায় ছাত্রের জীবন শেষ হয়ে গেছে। সামান্য মতের অমিলের কারণে শিবির ট্যাগ দিয়ে পিটিয়ে থানায় দিয়ে এসেছে সাধারণ ছাত্রদের। মুক্ত চিন্তা আর বাক-স্বাধীনতার প্রতীক পুরো ঢাবি তৈরি হয়েছে স্বৈরশাসকের আয়নাঘরে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ত্রাস সৃষ্টিকারীরা আজ নেই। তাদের আশ্রয়দাতা সরকারও দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমাদের প্রশ্ন আসতেই পারে, আমরা কেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চাই?

সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি, ঢাবি হবে সম্পূর্ণ লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিমুক্ত। যেখানে শিক্ষার পরিবেশ থাকবে, প্রতিযোগিতা হবে গবেষণা নিয়ে, গবেষণার ক্ষেত্রে বাজেট বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের ক্লাস বাদ দিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরের কাজের প্রতি আগ্রহ ও অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যাওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য লাইব্রেরি ও সেমিনার কক্ষ সংস্কার করে আরও উন্নত ও আধুনিক রূপ দিতে হবে। ঢাবির মেডিকেল সেন্টারকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের চিত্ত-বিনোদন ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে যত্নবান হতে হবে।

হলগুলোতে কোনো গণরুম থাকবে না। প্রতিটি শিক্ষার্থীর ঘুমানোর জন্য একটা চৌকি ও পড়ার জন্য একটি টেবিল অন্তত পাবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চায়ন করবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করবে। যদি কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও টর্চার সেলের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে চায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করবে।

শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি, ঢাবির আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ে অগ্রগতি। গবেষণা ও মুক্ত চিন্তার পরিবেশ তৈরি করা না গেলে, তা কোনোমতেই সম্ভব নয়। আধুনিক টেকনোলজির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের হয়রানি বন্ধের জন্য সম্পূর্ণ ডিজিটাল ক্যাম্পাস গঠন করতে হবে। শিক্ষার্থীরা এমন ঢাবি চান, যেন আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও দেশ গঠনে নেতৃত্ব দিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামের স্বার্থকতা পাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়