ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ম্যুরালের ছবিতে কমেন্ট করায় শিক্ষা জীবন শেষ নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীর

নোবিপ্রবি সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৩:৫৬, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বঙ্গবন্ধু ম্যুরালের ছবিতে কমেন্ট করায় শিক্ষা জীবন শেষ নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীর

(বাঁ থেকে) আইন বিভাগের চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া, ভুক্তভোগী ফয়েজ ও তার ভাই রাজু

বঙ্গবন্ধু ম্যুরালের ছবি সম্বলিত ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট করা নিয়ে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়েজ আহমেদকে সাময়িক বহিষ্কার, শোকজ ও জেলখানায় পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। জামিনে ছাড়া পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ বঞ্চিত হয়ে শিক্ষা জীবনের চারটি বছর হারিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ সেশনের এ শিক্ষার্থী।

সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ফয়েজ সাংবাদিকদের এ সব কথা বলেন। এ সময় তার বড় ভাই রাজু আহমেদও উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু ম্যুরালের ছবি এডিট করে একটি ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা হয়। সেখানে কমেন্ট করেন ফয়েজ আহমেদ। এ নিয়ে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে পাঁচদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটক করে কারাগারে পাঠায়। দীর্ঘ চার মাস কারাগারে কাটানোর পর নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জামিনে ছাড়া পান তিনি।

ফয়েজ বলেন, ১৪ অক্টোবর ২০২০ সালে মুহম্মদ মুমিন আদ দ্বীন নামক একটি আইডি থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ নামক একটি গ্রুপে নোবিপ্রবির বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ভিপি নুরের ছবি এডিট করে পোস্ট করেন। সেই পোস্টটি সমালোচনা করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার নাসের আবার পোস্ট করেন। সেখানে আমি কমেন্ট করে বলি, এখানে দুঃসাহসের কিছু তো দেখছি না। এই একটি কমেন্টের কারণে আমাকে জেল জুলুম খাটিয়েও ক্ষ্যান্ত হয়নি। বেআইনিভাবে আমাকে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, ঘটনার পর কোনো তদন্ত ছাড়াই ওইদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমাকে সাময়িক বহিষ্কার দিয়ে পাঁচদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরে এ ঘটনায় শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান বিপ্লব মল্লিককে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যেখানে সদস্য হিসেবে ছিলেন তৎকালীন প্রক্টর নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফিরোজ আহমেদ, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক আফসানা মৌসুমী, ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম হলের প্রাধ্যক্ষ আনিসুজ্জামান রিমন এবং সদস্য সচিব হিসেবে ছিলেন নোবিপ্রবি বিএনসিসির পিইউও এ কিউ এম সালাউদ্দিন পাঠান। 

কোনো প্রকার মামলা ছাড়াই আমাকে পরদিন গ্রেপ্তার করা হয়। ১৬ অক্টোবর নোবিপ্রবি ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতা প্রিতম আহমেদ বাদী হয়ে আমার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার মামলা দায়ের করেন। যেখানে সাক্ষী হিসেবে ছিলেন, তৎকালীন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার নাসের, শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সজিব এবং বিএমএস বিভাগের শিক্ষার্থী ও পরবর্তীতে ছাত্রলীগ নেতা সাব্বির। দীর্ঘ চার মাস আমি কারাগারে থেকে পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জামিন পেয়ে বের হয়ে আসি। 

ফয়েজ অভিযোগ করে বলেন, আমি কারাগারে থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা তো করেইনি; বরং আমার পরিবারকেও নানাভাবে হেনস্তা করেছে। কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯ অক্টোবর ২০২০ তারিখে আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আমার বড় ভাই রাজু আহম্মদ বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের চেয়ে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করে। কিন্তু সেই প্রত্যাহার আবেদনটি রেজিস্ট্রার বরাবর ফরওয়ার্ডিং করতে বাধা দেয় আইন বিভাগের চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া। পরবর্তীতে প্রায় প্রতিদিনই আমার পরিবার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করতো। কিন্তু আমার নিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ফরওয়ার্ডিং না দিয়ে উল্টো আমার পরিবারকে হেনস্তা করেছিল।

তার অভিযোগ, আমি যখন কারাগার থেকে বের হই, ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য আমি এবং আমার পরিবার প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে যেতাম। তারা বলতো তোমার বিভাগের চেয়ারম্যান অনুমতি দিলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আবার যখন চেয়ারম্যানের কাছে যেতাম, তখন তিনি বলতেন আমার হাতে কিছু নেই। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিষয়ে কোনো আপোষ আমি করতে পারবো না। 

ভুক্তভোগী এ শিক্ষার্থী বলেন, এভাবে দীর্ঘ চার বছর নানাভাবে চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি। আমার সহপাঠীরা যখন ক্লাস করতেন, তখন আমি চেয়ারম্যানের অফিসে বসে বসে চোখের পানি ফেলতাম। আমার বাবা একজন আলেম, ভাই শিক্ষক। তারা আমার পরিবারকে দিনের পর দিন লাঞ্চিত করতো। আইন বিভাগের চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া আমার পরিবারকে নানাভাবে হেনস্তা করতো। আজকে পড়ালেখা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। মিথ্যা মামলা এবং হয়রানির কারণে ঋণে জর্জরিত হয়ে আমার পরিবার আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে। এছাড়াও গত ৫ আগস্টের পর আমি তাকে আমার সঙ্গে করা অন্যায় স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি নোয়াখালীতে দায়িত্বরত সেনবাহিনীর অফিসার দিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দুঃখ প্রকাশ করে তাকে শান্তির আওতায় নিয়ে আসে। 

তার সঙ্গে করা অন্যায়ের বিচার চেয়ে তিনি বলেন, আমি এর বিচার চাই। নোবিপ্রবি প্রশাসন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আমার ও আমার পরিবারের সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের বিচার চাই।

ভুক্তভোগী ফয়েজ আহমেদের বড় ভাই রাজু আহমেদ বলেন, একটা মিথ্যা এবং বানোয়াট বিষয়ে আমার ভাইয়ের জীবনটা তারা নষ্ট করে দিয়েছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিচার হলেও সে ক্লাস পরীক্ষায় ফিরতে পারেনি। দীর্ঘ তিন বছর অমানুষিক কষ্ট করেছি আমরা। শত চেষ্টা করেও নোবিপ্রবিতে পড়ালেখা শুরু না করতে পেরে আমরা তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যারা এর জন্য দায়ী, আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের বিচার চাই। বিশেষ করে যারা তদন্ত কমিটিতে ছিল, তারাও এর জন্য দায়ী। তারা কোনো প্রকার তদন্ত না করেই ফয়েজকে সাময়িক বহিষ্কার দিয়েছে এবং পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তারা আওয়ামী দোসরদের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। 

অভিযোগের বিষয়ে আইন বিভাগের চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা। প্রথমত বহিষ্কার করা এবং ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বোর্ড এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের হাতে। সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে ওর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছি আমি। কিন্তু মামলা চলায় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল তা আমলে নেয়নি। এর বাহিরে ওর পরিবারের সঙ্গে আমি কখনো খারাপ ব্যবহার করিনি।
‘ধর্ষণ মামলার আসামী হলেও আমি বিবেচনা করবো, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের বিষয়ে কোনো আপোষ নেই’- তার দেওয়া এমন বক্তব্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।

৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর দায়িত্বরত অফিসার দিয়ে ফয়েজকে তুলে নেওয়া হবে- এমন হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে বাদশা মিয়া জানান, উল্টো ভুক্তোভোগী তাকে মারার হুমকি দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি নিরাপত্তা নিতে সেনাবাহিনীর হেল্প লাইনে অভিযোগ জানিয়েছেন। 

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বিপ্লব মল্লিক বলেন, এতদিন আগের ঘটনা এখন মনে পড়ছে না। এর বাহিরে কোনো কথা বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে  নোবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল বলেন, আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়েজের বিষয়ে আমি অবগত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের সঙ্গে ফয়েজের যোগাযোগ হয়েছে। সে যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট লিখিত অভিযোগ জমা দেয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার শিক্ষাজীবন যেন দ্রুত শেষ করতে পারে, আমরা এ বিষয়ে সহযোগিতা করবো।

/ফাহিম/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়