ঢাকা     শুক্রবার   ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৫ ১৪৩১

ঢাবির গণবিবাহ নিয়ে যা ভাবছেন নারী শিক্ষার্থীরা

ক্যাম্পাস ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪  
ঢাবির গণবিবাহ নিয়ে যা ভাবছেন নারী শিক্ষার্থীরা

জুলাই বিপ্লবের পরে স্বাধীনতা উদযাপন উপলক্ষে আগামীকাল শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) স্বাধীনতা ভোজ ও গণবিবাহের আয়োজনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এতে প্রয়োজন নেই টাকার, নেই কোনো খরচ, শুধু দরকার পাত্র কিংবা পাত্রীর। এ বিয়ের সব খরচ বহনের ঘোষণা দিয়েছিলেন শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থীরা। 

এ গণবিয়ের ঘোষণা আসার সঙ্গে দেশব্যাপী নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরে বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হলে এ গণবিবাহ আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানায় ঢাবি প্রশাসন। একইসঙ্গে এ ধরনের আয়োজন, অভ্যর্থনা বা গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানায় ঢাবি কর্তৃপক্ষ।

ঢাবি শিক্ষার্থীদের গণবিবাহ অনুষ্ঠান না হলেও এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা রাইজিংবিডির কাছে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন।

‘সিভি ড্রপ’ কর্মসূচি দেখে খুবই বিরক্ত লাগছে

যদি পুরানো প্রেম থাকে আর বাসা থেকে সম্মতি থাকে, তবে আমি গণবিবাহের পক্ষে। এতে করে যাদের বিয়ে করার পরিকল্পনা আছে, কিন্তু  স্টুডেন্ট হওয়ায় সামর্থ নেই, তাদের ক্ষেত্রে অনেক সহজ হবে।  তবে যদি সম্পূর্ণ নতুন কাউকে বিয়ে করার জন্য হয়, তাহলে সম্পূর্ন বিপক্ষে। কারণ বিয়ে কোনো ছেলেখেলা না।

এখন অনেক জুটিই বিয়ে করে নিত। সে ক্ষেত্রে হল থেকে অনুমতি দিলে ভালোই হইতো I আমি মনে করি এ বিয়ের একটা বৈধতা থাকতো। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও আরলি ম্যারেজ এবং হারাম থেকে বের হয়ে আসার একটা সহজ উপায় হতে পারতো গণবিবাহ।

মোটকথা, যদি আগে থেকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া থাকে, তাহলে গণবিবাহে কোনো সমস্যা আমি দেখি না। তবে দুই এক দিনের পরিচয়ে বিয়ে করে নেওয়াটা আমার কাছে বোকামি মনে হইছে। সবার ওই ‘সিভি ড্রপ’ কর্মসূচি দেখে খুবই বিরক্ত লাগছে।
(লেখক: হাফিজ সুলতানা তন্নি, শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

গণবিবাহ সাময়িক মজার জন্যই ভালো

বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন। দুজন মানুষ সারাজীবনের জন্য একে অপরের সঙ্গে থাকার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পোশাক স্বরূপ। কিন্তু বিয়ে শুধু স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে না, এই সম্পর্ক তৈরি হয় দুটো পরিবারের মধ্যে।

এখন এই যে গণবিবাহ নিয়ে যেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে আমি সেটা সমর্থন করছি না। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি, একটা মেয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে এবং একটা ছেলে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। এখন দুজন দুজনকে ভালোবাসে তাদের বোঝাপড়া ভালো, মনে হয় পারফেক্ট কাপল। কিন্তু দেখা যায় ছেলের পরিবারের অভ্যাস মেয়ের পরিবারের সঙ্গে মেলে না। মেয়েটা নিশ্চয়ই তার পরিবারের অভ্যাস ফলো করবে। যখন মেয়েটি এগুলো দেখবে, তার মধ্যে হীনমন্যতা কাজ করবে। যা উভয়ের সম্পর্কে খারাপ প্রভাব পড়বে।

বাঙালিদের মাঝে বিভিন্ন কালচার প্রচলিত আছে। যদি ছেলের পরিবার বা মেয়ের পরিবার এগুলো ঠিকমতো ফলো না করে, সেখানে ঝামেলা তৈরি হয়। সম্পর্কের ছন্দপতন হয়। পরিবার ও সংসার জীবন সুখী হওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা রাখে। যদি পারিবারিক ঝামেলা থাকে, তাহলে নিশ্চিত থাকা যায় সেই বিয়ে টিকবে না।

আমার পরিচিত এক কাপল বিয়ে করেছে। ছেলের পরিবার থেকে মেয়েটাকে পছন্দ করছে না। এজন্য মেয়েটা খুব একটা ছেলের বাড়িতে থাকে না। এত কিছুর মধ্যে তাদের বিচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু ছেলের মা ছেলের জন্য বউ খুঁজছে আবার বিয়ে করাবে।

এজন্য বলছি, এ সব গণবিবাহ আসলে সাময়িক মজা করার জন্য ভালো লাগে। কিন্তু এটা কখনোই সফল হবে না, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একেবারেই না। যদি পছন্দ হয়, তাহলে দুই পরিবার বসে আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
(লেখক: সানজিদা ইয়াসমিন, শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)

বিয়েকে সহজ করা হোক

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণবিবাহের উদ্যোগের পক্ষে। এটা নিয়ে মিডিয়া পাড়ার মানুষ কথা বলুক, সমাজের নানান শ্রেণির মানুষ কথা বলুক, বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল করা হুজুরেরা কথা বলুক। ২৫ এর আগে বিয়ে দেওয়া হোক, সামর্থ্য হলেই বিয়ে দেওয়া হোক, মেয়ের পছন্দের ছেলের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হোক, অন্তরের দ্বীন দেখে বিয়ে করা হোক। বিয়েকে সহজ করা হোক, সন্তানকে মানসিক ট্রমা থেকে মুক্ত করা হোক, সন্তানের চরিত্রকে হেফাজত করা হোক।

ছেলেরা পড়াশোনা চালিয়ে যাক, নিজে ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করুক। ছেলের সফলতা ও চরিত্র দেখে মেয়েরা পছন্দ করবে। মেয়ে যেমন ছেলে যখনই পছন্দ করবে, তখনই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক। ভার্সিটিতে পড়াশোনা চলাকালীন বিয়ে হোক, ২৫ এর মধ্যেই বিয়ে হোক। দুজনে ভালোবেসে নিজেদের মতো জীবনযাপন করুক। স্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করে বয়স অনুযায়ীই বিয়ে হোক।

মাঝে অনেক ডাক্তাররা বলতেন, ছেলেদের ২১ বছর বয়সের পরে ও মেয়েদের ১৮ বছর বয়সের পরে বিয়ে করা উচিৎ। এমন বয়সের নিচে বিয়ে করলে নাকি শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়, মেয়েদের নাকি সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়ে মৃত্যু হতে পারে। তাই এমন আইন করা হয়েছিল। শুধু আমাদের দেশে না, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেও বিয়ের বয়স নিয়ে আইন করা আছে। বয়স হয়ে গেলে সামর্থ্য হয়ে গেলেই সেখানে বিয়ে করে ফেলে।

বিয়ের বয়স নিয়ে আইন মানলাম। কিন্তু তথাকথিত সুশীল সমাজের মানুষরা তো চাকরি না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দিতে চায় না, এটার পক্ষে আমি নই। এজন্য বয়স পার হতে হতে অনেকের বিয়ে সারাজীবনেও হয় না। জীবনটা একদম বরবাদ হয়ে যায়।

আমাদের দেশে তথাকথিত সুশীল সমাজের অনেক মানুষ চাকরিজীবী ছেলে ছাড়া মেয়ের বিয়েই দিতে চায় না। বয়স পার হতে হতে বিয়ে পর্যন্ত হয় না, আর হলেও সংসারটা সুখের হয় না। এজন্যই ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এতো ঝগড়া বিবাদ হয়। এজন্যই এতো নারী নির্যাতন। 

তাই ছেলেদের বিয়ের বয়স যদি ২১-২৫ এর মধ্যে হয়ে যায়, তখনই নিজের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনা করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ।

আশা করা যায়, বিয়েকে সহজ করা হলে সমাজটা সুন্দর হবে। তবে আইন থাকুক। আইনের পক্ষে আছি, তথাকথিত সুশীল সমাজের মানুষের পক্ষে নই।
(লেখক: সানজিদা নাহার হীরা, শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)

স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়

১৯৭১ সালে শহিদদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। ২০২৪ সালে এসেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণদের রক্ত গড়িয়ে আমরা নতুন এক বাংলাদেশ পেয়েছি। স্বাধীনতা ২.০ উদযাপন ভালো কাজ। তবে এমন কিছু না হোক, যা আমাদের সমালোচনার জন্ম দিবে। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। স্বাধীনতা হলো নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়া।

বিবাহ হলো একটি সামাজিক বন্ধন। জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কেটে যায় জীবন সঙ্গীর সঙ্গে। বিবাহের মাধ্যমে পরিবারের সূত্রপাত হয়। তাই হুটহাট যেকোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আবেগের বশে কাজ করার আগে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। সমাজের মূল্যবোধ আমাদের সবার মেনে চলা উচিত। আমার প্রিয় ক্যাম্পাস কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা ২.০ উদযাপন উপলক্ষে গণবিবাহের আয়োজন নেই।
(লেখক: তাসফিয়া তাসনিম আরশি, শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)

এ আয়োজনের যৌক্তিকতা নেই

বিয়ে নিজস্ব ব্যপার। পরস্পরের মত না থাকলে বিয়ে হয় না। আর গণ বিয়ের আয়োজনে যদি কোনো নারীই না আসে, তাহলে আমি মনে করি, এখানে বড় রকমের টাকা অপচয় হচ্ছে। এ আয়োজনের যৌক্তিকতা পাচ্ছি না।

গণবিয়ে কারা করবে? তাদের লিস্ট কি নেওয়া হয়েছে? লিস্ট নেওয়া না হলে এই আয়োজনের যৌক্তিকতা কোথায়?  আর লিস্ট নেওয়া হলে নারীরা কেনো আসছে না?

নারীদের না আসার কারণ, আমার মনে হয় আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট। নারীরা বর্তমান সময়ে অনেকেই সাবলম্বী। তাই তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের সমান বা বেটার ছেলে খোঁজে। হয়তো এই কারণেও নারীরা গণবিয়েতে অংশগ্রহণ করছে না।

প্রশাসনের উচিত, এতগুলো টাকা এ খাতে খরচ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নে এ টাকা খরচ করা অথবা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষামূলক বৃত্তি প্রদান করা। শুনেছি ঢাবি প্রশাসন এ গণবিবাগের অনুমতি দেয়নি। এর জন্য অবশ্য ঢাবি প্রশাসন প্রসংশার যোগ্য।
(লেখক: জয়িতা মিমৌ, শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়