ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৯ ১৪৩১

রাবি শিক্ষার্থীকে র‌্যাগিং

‘আবরার ফাহাদের মতো করে মারলে কী করবি?’

রাবি সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৩:৩৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
‘আবরার ফাহাদের মতো করে মারলে কী করবি?’

অভিযুক্ত (বাঁ থেকে) অন্তর বিশ্বাস ও নাজমুল হোসেন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে এক নবীন শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাসের নিজ কক্ষে র‍্যাগিং ও আবরার ফাহাদের মতো পিটিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া তাকে ছাত্রাবাসে শিবির ডেকে মারার হুমকিও দেওয়া হয়।

সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় নিরাপত্তা চেয়ে প্রক্টর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগপত্র দিয়েছেন ভুক্তভোগী মোহাম্মদ রকি। তিনি দর্শন বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে অভিযুক্তরা হলেন- মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তর বিশ্বাস, একই বিভাগের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন নাবিল। তবে তাদের অন্য সহযোগীদের নাম জানা যায়নি।

অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, রাবি সংলগ্ন বিনোদপুরের লেবুবাগান এলাকার বিশ্বাস ম্যানসন ছাত্রাবাসের ২০৪ নম্বর কক্ষে থাকছিলেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে ১২টার দিকে একই ছাত্রাবাসের ২০১ নম্বর কক্ষের নাজমুল হোসেন নাবিল ও ২০৫ নম্বর কক্ষের অন্তর বিশ্বাস ভুক্তভোগীর কক্ষে প্রবেশ করেন। শুরুতেই অভিযুক্তরা তাকে নানা রকম বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। ফলে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

এক পর্যায়ে অভিযুক্তরা বলেন, ‘তোকে গেস্টরুমে নিয়ে যাব, গেস্টরুমে নিয়ে গিয়ে তোকে আদর আপ্যায়ন করব।’ এরপর তারা বলেন, ‘শেষবারের মতো তোর মাকে কল দে। কল দিয়ে বল আর কোনদিন দেখা নাও হতে পারে। আমি কোনো ভুল করলে আমাকে মাফ করে দিও।’

এক পর্যায়ে অভিযুক্তরা বলেন, ‘আবরার ফাহাদকে কিভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল জানিস?’ উত্তরে ভুক্তভোগী বলেন, ‘জ্বি ভাই পিটিয়ে মারা হয়েছিল।’ তারপর অভিযুক্তরা বলেন, ‘তোকে এভাবে মারলে তখন কি করবি?’ উত্তরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী চুপ থাকেন।

এরপর অভিযুক্তরা রকিকে হুমকি দিয়ে একাধিকবার হলের গেস্টরুমে যেতে বলে। ভুক্তভোগী গেস্টরুমে যেতে অস্বীকৃতি জানালে তারা বলেন, ‘তুই যদি হলের গেস্টরুমে যেতে না চাস তাহলে, মেসে শিবির ডেকে নিয়ে এসে তোকে মারবো।’

এরপর তারা ভুক্তভোগী মোহাম্মদ রকিকে বলেন, ‘তোর রুমমেটদের সেমিস্টার ফাইনাল ৭ তারিখে শেষ হবে। ৮ তারিখ থেকে রাতে তোর সাথে আমরা পার্টি দিব।’

অভিযোগপত্র ভুক্তভোগী বলেন, তারা আনুমানিক রাত দেড়টার দিকে আমার কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। এমতাবঅস্থায় আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। 

ভুক্তভোগী মোহাম্মদ রকি রাইজিংবিডিকে বলেন, আমি গতকালই (সোমবার) ওই মেস ছেড়ে দিয়েছি। বর্তমানে আমার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মেসে থাকছি। অভিযোগ দেওয়ার পর প্রক্টর স্যার খুব সহযোগিতা করেছেন এবং তিনি আমার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। এছাড়া স্যাররা সবসময় খোঁজখবর নিচ্ছেন।

এদিকে, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রক্টর অফিসে দুই পক্ষকে ডাকা হয়। এ সময় দুই সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দীন ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মশিহুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। 

অভিযুক্ত মার্কেটিং বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন নাবিল বলেন, গতকাল আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিভাগের বড় ভাই ওই ছেলের রুমে নিয়ে যান। যখন আমি রুমে যাই, তখন আমার বিভাগের বড় ভাই তার (রকি) সঙ্গে মজা করে। আমিও ছিলাম পিছনে। কিন্তু আমি সে রকম ইনফ্লুয়েন্স করিনি। শিবির কথাবার্তা, মারা বা কোনো অত্যাচার করিনি। আমি তাকে বলে এসেছি তোমরা ফ্লোরে একসঙ্গে আছো, মিলেমিশে থাকবা। রুমে আসবা আড্ডা দিবা। তোমার কোনো সমস্যা হলে আমাকে নক করতে পারো।

আবরার ফাহাদের মতো হত্যার হুমকি বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আমরা উদাহরণ হিসেবে বলেছি। আমরা বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সে রকম নেই যে, আবরার ফাহাদের মতো হবে। তারসঙ্গে এমন হলে আমাদের জানাতে বলেছি। কিন্তু সে বিষয়টি অন্যভাবে নিয়েছে।

অভিযুক্ত আরেক শিক্ষার্থী মো. অন্তর বিশ্বাস বলেন, আমি তার সঙ্গে খুবই নরমালি কথা বলি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, তার সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক তৈরি করা। কিন্তু ব্যাপারটা এতোদূরে চলে যাবে, আমি বুঝতে পারিনি। ওই শিক্ষার্থীকে আমরা হুমকি দিয়েছি এমনভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে, এ ব্যাপারটি ভুল। আমি তাকে বলেছিলাম, আবরার ফাহাদের সঙ্গে যেটা ঘটেছে ওটা র‍্যাগিং। কিন্তু তোমার সঙ্গে যেমনভাবে কথাবার্তা হচ্ছে এটাকে তুমি র‍্যাগিং হিসেবে নিও না। আর শিবিরের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমান বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। গতকাল আমরা নতুন শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, অত্যন্ত চমৎকার একটা দিন ছিল। কিন্তু আজকের দিনটি কিছুটা হলেও বিষাদময়। কারণ একজন নতুন শিক্ষার্থীকে যেভাবে র‍্যাগিং দেওয়া হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা শিক্ষক হিসেবে এই বিষয়গুলোকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিতে পারিনা।

তিনি বলেন, অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা আমরা করবো। অভিযোগ ও স্বীকারোক্তির তথ্যগুলো আমরা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিভাগে আমরা প্রেরণ করবো। বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটি একটা সুপারিশমালা তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটিতে দিবে। সেই অনুযায়ী শৃঙ্খলা কমিটি সিদ্ধান্ত নিবে।

এর আগে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর র‍্যাগিং সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রক্টর জানান, র‍্যাগিং একটি সামাজিক অপরাধ। এর ফলে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়া ছাড়াও র‍্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোথায় কোনো প্রকার র‍্যাগিং না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কেউ র‍্যাগিং করলে বা কাউকে র‍্যাগিং করতে উদ্বুদ্ধ করলে প্রমাণ সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক শাস্তি প্রদান করা হবে।

/ফাহিম/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়