ঢাকা     শুক্রবার   ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ১২ ১৪৩১

বাজারের সবজিতে অসহনীয় মাত্রায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ভারী ধাতুর উপস্থিতি

মো. লিখন ইসলাম, বাকৃবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৫৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২২:০৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বাজারের সবজিতে অসহনীয় মাত্রায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ভারী ধাতুর উপস্থিতি

কলকারখানা অধ্যুষিত এলাকার শাক-সবজিতে মিলছে ভারী ধাতুর উপস্থিতি, যা বৃদ্ধি করছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ফলে এসব সবজি দীর্ঘমেয়াদে গ্রহণের ফলে মানবদেহে বাড়াচ্ছে ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারের ঝুঁকি।

বিশেষ করে লাল শাক, শিম, ঢেঁড়স, পটলের মতো সবজিতে মিলছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে ক্ষতিকর ভারী ধাতুর উপস্থিতি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসাইন সুমন, অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়ার বাজারে পাওয়া যায় এমন সবজিতে রাসায়নিকের মাত্রা নিয়ে করা একটি যৌথ গবেষণায় এ সব তথ্য উঠে এসেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চলমান একটি গবেষণা প্রজেক্টের অংশ হিসেবে ওই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন তারা। 

গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে বলা হয়, শিল্প কলকারখানা বেশি রয়েছে এমন এলাকার বাজার থেকে সংগৃহীত নয়টি সবজিতে মানবদেহের সহনীয় মাত্রার বেশি হেভিমেটাল বা ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। সংগ্রহকৃত নয় ধরনের সবজির মধ্যে ছিল আলু, বেগুন, ঢেঁড়স, টমেটো, লালশাক, পটল, বাঁধাকপি, শসা ও মটরশুঁটি।

গবেষণাগারে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলছেন অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসাইন সুমন

এর মধ্যে, লাল শাকে ভারী ধাতু ক্যাডমিয়াম (যা অন্যতম কার্সিনোজেনিক বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান) সহনীয় মাত্রার অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। এসব সবজিতে লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামসহ বেশ কয়েকটি রাসায়নিকের উচ্চ মাত্রার উপস্থিতিও রয়েছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, যেখানে সবজিতে ক্যাডমিয়ামের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা প্রতি কেজিতে ১৯০ মাইক্রো গ্রাম। সেখানে লালশাকে পাওয়া গেছে ৭০৪.৩২ মাইক্রো গ্রাম। বেগুনে প্রতি কেজিতে ২৭৫.৬৬, ঢেঁড়সে ৩৪৯ ও টমেটোতে ১৯৫ মাইক্রো গ্রাম ক্যাডমিয়াম মিলেছে।

একইভাবে ক্রোমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে শিম, শসা, ঢেঁড়স, পটল ও লাল শাকে। প্রতি কেজিতে যেখানে এ ধাতুর সর্বোচ্চ মাত্রা ২৩০০ মাইক্রো গ্রাম। সেখানে লালশাকে এর মাত্রা ছিল ২৮২৬.৮৬ মাইক্রো গ্রাম। লেডের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে বেগুন, বাঁধাকপি, শিম, শসা, ঢেঁড়স, পটল, টমেটো ও লালশাকসহ নয়টি সবজিতে।

গবেষণাটি করতে বেশি কলকারখানা কবলিত অঞ্চল ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের বাজার থেকে পাওয়া শাক-সবজির নমুনা এবং তুলনামূলক কম কলকারখানা কবলিত ময়মনসিংহ, জামালপুর ও শেরপুর থেকে এ সব সবজির ১৭২টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে, ক্যাডমিয়ামের সর্বোচ্চ উপস্থিতি পাওয়া গেছে নারায়ণগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় এবং ক্রোমিয়াম ধাতুটি সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ময়মনিসংহ জেলায় এবং সর্বনিম্ন নারায়ণগঞ্জে। এছাড়াও ভারী ধাতু লেডের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল নারায়ণগঞ্জে এবং কম ছিল জামালপুরে।

গবেষণাগারে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া

গবেষণার বিষয়ে বাকৃবির অন্যতম গবেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া বলেন, গবেষণার জন্য আমরা ছয়টি জেলার প্রত্যেকটি তিনটি বাজার থেকে নয়টি শাক-সবজির সর্বমোট ১৭২টি নমুনা সংগ্রহ করি। পরে এগুলো ল্যাবে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ উপযোগী করে তোলা হয়। এরপর বাকৃবির কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মেশিনের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা হয়। বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণে ম্যাস স্পেক্ট্রোমেট্রি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। 

এ বিষয়ে দলের অন্যতম গবেষক অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসাইন সুমন বলেন, দেশে ক্রমাগত শিল্প কলকারখানা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সব শিল্প কলকারখানা থেকে নিষ্কাশিত বর্জ্য ভালো মতো পরিশোধন না করেই আশেপাশের জমি বা নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকেই ভারী ধাতু যেমন- আর্সেনিক, লেড, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি আবাদি জমিতে যাচ্ছে। জমি থেকে সেগুলো সবজি বা ফসলে যাচ্ছে। আমরা সবজির পুরো অংশ যেহেতু ভক্ষণ করি। তাই এর থেকে এ সব ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এ ভারী ধাতুগুলো সহনীয় মাত্রার বেশি পরিমাণে যদি কারো দেহে দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রবেশ করতে থাকে, তাহলে তার দেহে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয় এবং এক সময় ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।

তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে দেশের কোন অঞ্চলের মাটিতে কোন ধরনের ভারী ধাতু বেশি রয়েছে সেটা একটি সমীক্ষা চালানো উচিত। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে এ সব শাক-সবজি দূষিত মাটি, পানি ও শিল্পাঞ্চলের আশেপাশে চাষ করা উচিত নয়। আর্সেনিকের দূষণ মোকাবেলায় যে সব জমিতে আর্সেনিক বেশি থাকে, সেখানে ধান চাষ না করে অন্য ফসল চাষ করা। এছাড়াও শাক সবজি ও ফলমূলে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে বিস্তর আকারে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বিশিষ্ট মৃত্তিকা বিজ্ঞানী।

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়