ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

চশমা পরা ও মুখ পোড়া হনুমানের সংকরায়ন নিয়ে যা বলছেন গবেষকরা

আহসান হাবীব, জাবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩১, ৩ অক্টোবর ২০২৪  
চশমা পরা ও মুখ পোড়া হনুমানের সংকরায়ন নিয়ে যা বলছেন গবেষকরা

মুখ পোড়া (বামে) ও দুটো হনুমানের মধ্যে সংকরায়িত বাচ্চা। ছবি- রাসেল দেববর্মা

বৈচিত্র্যময় নানা প্রজাতির প্রাণীর বাস আমাদের এই পৃথিবীতে। কালের আবর্তে অনেক প্রাণীই আমাদের চোখের অন্তরালে রয়ে গেছে। অনেকে আবার প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেছে ধীরে ধীরে। চির সবুজের এই বাংলাদেশেও প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে বৈচিত্র্য।

হনুমান প্রজাতির মধ্যে দেশে চশমা পরা হনুমান ও মুখ পোড়া হনুমান এক সময় অহরহ দেখা যেত। তবে এ দুটি হনুমানের প্রজাতিকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেশের পূর্বাঞ্চলে এ দুটি প্রজাতির মধ্যে প্রথমবারের মতো হাইব্রিডাইজেশন তথা সংকরায়নের বিষয়টি উঠে এসেছে। 

গবেষকরা বলছেন, সাধারণত প্রাইমেটদের মধ্যে সংকরায়ণের ঘটনা খুবই বিরল। সম্পূর্ণ বিপরীত জীবনধারার দুটি প্রজাতির বিচরণের এলাকা একই হয়ে গেলে এ ঘটনা ঘটতে পারে। মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড যেমন- বন উজাড়, বন্যপ্রাণী শিকার, ফাঁদে ফেলে বন্যপ্রাণী ধরা ইত্যাদি এদের সংখ্যা কমানোয় ভূমিকা রাখে। এতে এ ধরনের সংকরায়ণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তবে এ হাইব্রিডাইজেশন তথা সংকরায়ন এক বা উভয় প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

জানা গেছে, ২০২১ সালে হবিগঞ্জ জেলার মৌলভীবাজারের রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে একটি মুখপোড়া হনুমানের দলের সঙ্গে চশমা পরা হনুমানের ঘুরে বেড়ানো কথা শোনা যায়। ঘটনা শুনে সেখানে ছুটে যান শখের ফটোগ্রাফার অরিত্র সাত্তার। প্রাণীপ্রেমী অরিত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৫২ ব্যাচের শিক্ষার্থী।

উপরে মুখ পোড়া হনুমানের কোলে হলুদ রঙের শংকর বাচ্চা এবং নিচেরটা চশমা পরা হনুমান। ছবি- রাসেল দেববর্মা

তার তোলা ছবিতে একটি বানরের দলের মধ্যে একটা ব্যতিক্রমী বাচ্চা দেখা যায়। এরই জের ধরে বাচ্চাটির দৈহিক বৈশিষ্ট্যে ভিত্তিতে কালেঙ্গাতে প্রথম এ দুই হনুমানের সংকরায়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছুদিন পর সাতছড়িতে আরও একটি হনুমানের দল পাওয়া যায়। এরপর বিস্তারিত গবেষণায় এ বিষয়ে আগ্রহী হন বিশ্বখ্যাত জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং আইইউসিএন প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য তানভীর আহমেদ। তিনি দীর্ঘ আট বছর ধরে এনিয়ে গবেষণা করছেন।

সংকরায়নের বিষয়টি জিনগতভাবে প্রমাণ করতে ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তানভীর আহমেদের নেতৃত্বে অরিত্র সাত্তারসহ ১৫ জনের একটি পেপার ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব প্রাইমেটোলোজিতে প্রকাশ করা হয়। এ গবেষণাপত্রে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমানের যৌথ দল তৈরি ও সাম্প্রতিক সময়ে সংকরায়ন নিয়ে সিলেট বিভাগের পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরেন। এর জন্য ১৫ জনের এই গবেষক দলের প্রায় ছয় বছর সময় লেগে যায়।

গবেষকরা জানান, এ জরিপে সিলেট বিভাগে মোট ৯৮টি হনুমান দল পাওয়া গিয়েছিল, যার মধ্যে আটটি ছিল চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমানের যৌথ দল। এসব দলে মোট হনুমান ছিল ১০৪২টি। গত বছর অক্টোবর পর্যন্ত মোট তিনটি সম্ভাব্য সংকর হনুমান দেখা যায়। একটি হনুমানের মলের জিনগত বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করা হয় যে চশমাপরা হনুমান ছিল বাবা এবং মুখপোড়া হনুমান মা। বিষয়টি এর আগের অন্যান্য পর্যবেক্ষণগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 

গবেষণার সহ-লেখক ড. ডিটমার জিনার বলেন, হনুমানগুলোর উপর সংকরায়নের জীনগত প্রভাব বোঝা এবং সংরক্ষণ কৌশল ঠিক করার জন্য অবশিষ্ট হনুমানগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও সংকর হনুমানের উপর গভীর গবেষণা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ গবেষণার ফলাফল একটি সতর্কবার্তা, এটি কেবল শুরু।

প্রাপ্তবয়স্ক সংকর হনুমান। ছবি- অরিত্র সাত্তার

জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের সিনিয়র বিজ্ঞানী ও লেখক অধ্যাপক ড. ক্রিস্টিয়ান রোস ব্যাখা করেন, বিপন্ন হনুমানগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ কৌশল তৈরির জন্য আমাদের আরও তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। সংকরায়নের বিস্তৃতি, মানুষের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সম্পর্ক এবং এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাবগুলো কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, তা বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, এটি কেবল স্থানীয় সমস্যা নয়—  এটি একটি বৃহত্তর, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের অংশ। যখন আবাসস্থলগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, প্রাণীরা এমনভাবে মিশ্রিত হয় যা প্রাকৃতিকভাবে ঘটতো না। এরই ফলস্বরূপ সেখানে সংকরায়ন ঘটতে পারে, এমনকি এক বা উভয় প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে পারে।

জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের পিএইচডি শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ এ ফলাফলের তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, সংকর হনুমানের উপস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। কারণ এটি ইঙ্গিত দেয়, এ দুই বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে জেনেটিক প্রবাহ তাদের ভবিষ্যৎ জেনেটিক গঠনে অপরিবর্তনীয় প্রভাব ফেলতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষণা দলের সদস্য অরিত্র সাত্তার বলেন, আমাদের এ অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যেই আমরা মানব সৃষ্ট কারণে ভারসাম্যহীনতা টের পাচ্ছি। পাখিদের মধ্যেও দেখা যায় নির্দিষ্ট পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে যারা বেশি মানুষের সঙ্গে অভিযোজিত, তাদের বড় ঝাঁকে কম অভিযোজিত পাখিরা, বিশেষ করে অন্য প্রজাতির কম বয়সী পাখিরা সংমিশ্রিত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের মধ্যে সংকরায়ন দেখা যায়। এটারই সম্প্রসারিত রূপ দেখতে পাচ্ছি আমাদের সিলেটের বনাঞ্চলগুলোতে, যেখানে চশমা পরা হনুমান এবং মুখ পোড়া হনুমানের মানবসৃষ্ট কারণে ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং চশমা পরা হনুমানের দলগুলোর পরিধি ছোট হওয়ায় সংকরায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়