ঢাকা     শনিবার   ১২ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২৭ ১৪৩১

গুলিবিদ্ধ চবি শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ

‘বুলেট বুকের ডান পাশ ভেদ করে ওপাশে বের হওয়ার কাছাকাছি ছিল’

এম. মিজানুর রহমান, চবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৬, ১২ অক্টোবর ২০২৪   আপডেট: ১৮:৪৬, ১২ অক্টোবর ২০২৪
‘বুলেট বুকের ডান পাশ ভেদ করে ওপাশে বের হওয়ার কাছাকাছি ছিল’

চব্বিশের আন্দোলনের মূলমন্ত্র ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার অবস্থান। সর্বপ্রথম কোটার বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও নানা ঘটনাক্রমে এটি রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এর জন্য ছাত্র-জনতাকে দিতে হয়েছে চড়ামূল্য। হাজার হাজার মানুষ নিহত, আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তেমনই আন্দোলনের এক অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন আব্দুল্লাহ।

আব্দুল্লাহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের আরবি সাহিত্য বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি আন্দোলনের একেবারে শুরু থেকে রাজপথে ছিলেন। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে বুক টানটান করে থাকতেন সম্মুখভাগে। 

জানা গেছে, চব্বিশের এ আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তারপর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্রই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে নিয়মিত কার্যক্রম চলতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি)। বলা যায়, পুরো চট্টগ্রামে আন্দোলনের মূল ছিল চবি। আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে ভড়কে যায় স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার। আন্দোলন স্তিমিত করতে গত ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে জোরপূর্বক বের করে দেয় শিক্ষার্থীদের।

উপায় না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী চলে যান নিজ এলাকায়। আব্দুল্লাহও চট্টগ্রামে বন্ধুর বাসায় কিছুদিন থেকে গত ১ আগস্ট নিজ এলাকা লক্ষীপুরে চলে যান। তবে তিনি আন্দোলন থেকে দূরে সরে যাননি। সেখানে গিয়ে তিনি অন্যান্যদের সঙ্গে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। একপর্যায়ে গত ৪ আগস্ট লক্ষীপুর সদরে কেন্দ্র ঘোষিত অসহযোগ কর্মসূচি পালনকালে বুকের ডানপাশে পাষাণ্ডের মরণঘাতী গুলি এসে বিদ্ধ হয়।

যে বুকভরা সাহস করে সামনে যেতেন, সেই বুকে গুলি লেগে মারাত্মক আহত হলেও এতটুকু মনোবল হারাননি আব্দুল্লাহ। দীর্ঘ চিকিৎসার পর প্রাণে বেঁচে যান অকুতোভয় এ সৈনিক। সুস্থ হয়ে দেখছেন এক নতুন বাংলাদেশ। 

আন্দোলন ও গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্মৃতিচারণ করে আব্দুল্লাহ বলেন, আন্দোলনের একেবারে শুরু থেকে চবির শহিদ মিনার থেকে যুক্ত হই। এরপর নিয়মিতই ছিলাম। গত ১৭ জুলাই যখন হলগুলো তালাবদ্ধ করে, তখন অনেকে বাড়িতে চলে যান। আমি অনেকদিন শহরে বন্ধুর বাসায় থেকে রাজপথে যেতাম। তখন নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকার কারণে আমরা একতাবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে যেতে পারতাম না। যেহেতু কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ ছিল না, অনিশ্চিতভাবে রাজপথে গিয়ে দেখি ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই চলে আসছেন। এভাবেই চট্টগ্রামে আমরা আন্দোলন চালাতাম।

তিনি বলেন, গত ১ আগস্ট নিজ বাড়ি লক্ষীপুরে যাই। ৪ আগস্ট আমরা শিক্ষার্থীরা লক্ষীপুর সদরে জমায়েত হই। একপর্যায়ে পুলিশ-ছাত্রলীগ আমাদের উপর হামলা শুরু করে। আমরা কয়েকজন সামনে ছিলাম। একটা সময় আওয়াজ আসে। আমি ককটেল ভেবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে টার্গেট করে কেউ গুলি করছে, এটা কল্পনাও করিনি। ককটেলের সাউন্ডের মতো ভেবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন আমার মনে হলো কিছু একটা বুকের ডান পাশ দিয়ে ভেদ করে। এর এক-দুই সেকেন্ড পর মনে হলো, আমার সামনের ভেতরের সবকিছু নিয়ে পেছনে চলে যাচ্ছে। সামনে একহাত দিয়ে আর পেছনে একহাত দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। এরপর একটা রিকশায় উঠলে চালক পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে চিকিৎসা দেননি। আওয়ামী লীগের নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যেন আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা না দেওয়া হয়। চিকিৎসা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এরপর হাসপাতাল থেকে সামান্য ওয়াশ করে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, এখান থেকে বাসায় গেলে পরদিন নোয়াখালীর মাইজদীর একটা হাসপাতালে যাই। যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ আমাদের অ্যাম্বুলেন্স চেক করে। কোনো আহত পেলে সেখানেই তারা মারধর করছিল। তবে আমি একটু কৌশলের জন্য বেঁচে যাই। ওই হাসপাতালেও প্রথমে অপারগতা জানালেও পরে আমার চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওটিতে নিয়ে বুলেটটা বের করা হয়। বুলেট বুকের ডান পাশ ভেদ করে ওপাশে বের হওয়ার কাছাকাছি ছিল। ডাক্তার সহজেই কাজটি করেন। ফুসফুস, লিভারে সামান্য আঘাত হলেও বড় ধরনের কিছু হয়নি। অবশেষে ২২ দিন রেস্টে থেকে পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠি।

স্বৈরাচারমুক্ত নতুন বাংলাদেশে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চাই একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আমাদের শতশত ভাই শহিদ হয়েছেন। অসংখ্য আহত হয়েছেন। তাদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না। পরবর্তীতে যদি আবারও কোন স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তার বিরুদ্ধে আমরা আবারও ঝাঁপিয়ে পড়বো।

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়