মহাকাশ বাণিজ্যে বিপ্লব ও বাংলাদেশ
রবিউল আওয়াল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম
বিজ্ঞানের সঙ্গে বাণিজ্যের খুব নিবিড় একটি সম্পর্ক রয়েছে। বিজ্ঞান মানব কল্যাণে কাজ করে, মানুষের জীবনকে উপভোগ্য ও সহজ করে তোলার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে। মহাকাশ নিয়ে অনাদিকাল থেকে মানুষের মনে কৌতুহলের কোনো সীমা ছিল না। বিজ্ঞানের কল্যাণ সেই মহাকাশ সম্পর্কে মানুষ শুধু জানছেই না, সঙ্গে এটাকে বাণিজ্যের বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
১৯৫৭ সালে প্রথমবারের মতো রাশিয়া স্পুটনিক-১ নামে একটি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠায়। তারপর কয়েক দশক কয়েকটি দেশে মহাকাশ গবেষণা ও বাণিজ্য সরকারি উদ্যোগে চলতে থাকে। তবে আশির দশক থেকে বেসরকারি পর্যায়ে মহাকাশ বাণিজ্য শুরু হয়, যা ২০০০ সালের পর থেকে রমরমাভাবে চলতে থাকে। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ১৫ হাজারের বেশি স্যাটেলাইট মহাকাশে রয়েছে। স্যাটেলাইটগুলোর উপর আমাদের দৈনন্দিন জীবন অনেকটা নির্ভরশীল। স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে, পৃথিবীব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট স্যাটেলাইটের সিগন্যালের উপর নির্ভরশীল। জিপিএস সিস্টেমও স্যাটেলাইটের ফসল।
স্যাটেলাইটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো আবহাওয়ার পূর্বাভাস। আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়ার ফলে অনেক বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বেঁচে যায়। উন্নত দেশগুলো সামরিক খাতেও ব্যাপকভাবে স্যাটেলাইটের ব্যবহার করছে। এই যে গ্রিনহাউজ গ্যাসের প্রভাবে আমাদের বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এ তথ্যগুলোও মূলত স্যাটেলাইট থেকেই প্রাপ্ত।
স্যাটেলাইটগুলো মহাকাশে নতুন নতুন গ্রহ, উপগ্রহ খোঁজার কাজে ব্যবহৃত হয়। সেগুলোর উদ্দেশ্য মহাকাশে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা এবং পৃথিবীবাসীর জন্য নতুন আবাসস্থল অনুসন্ধান করা। যাতে পৃথিবীতে মানবপ্রাণ বিপন্ন হয়ে উঠলে, নির্ভরযোগ্য একটি স্থানে আশ্রয় নিশ্চিত করা যায়। এছাড়াও মহাকাশ থেকে খনিজ সম্পদ আহরণেরও জোর প্রচেষ্টা চলছে। এতে সফল হলে, পৃথিবীর বাণিজ্যিক চেহারা ৩৬০° ঘুরে যাবে।
পাশাপাশি ‘স্পেস ট্রাভেল’ ও ‘মহাকাশে প্রয়োজনীয় পণ্যের যোগান’ মহাকাশ বাণিজ্যের নতুন দ্বার খুলে দিচ্ছে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন ধনকুবের অর্থের বিনিময়ে মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন এবং ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেস-এক্স আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তাদের নিজস্ব মহাকাশযানের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করেছে। স্পেস-এক্স, ব্লু অরিজিন, ভারজিন গ্যালাক্টিকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্পেস ট্রাভেল ও মহাকাশে পণ্য সরবরাহ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা স্পেস ট্রাভেলকে বেশ সম্ভাবনাময় খাত বলে বিবেচনা করছেন।
এছাড়া, জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বড় ভূমিকা রাখবে মহাকাশ অর্থনীতি। উইল মার্শালের গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৭টি এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার ১২টি অর্জনেই সহায়তা করবে স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাঠানো তথ্য।
মহাকাশের এ বাণিজ্যিকীকরণে যেমন বেশকিছু উপকারিতা রয়েছে তেমনি অপকারিতার সীমা নেই। আমরা যেমন অতিরিক্ত শিল্পায়নের ফলে পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছি, ঠিক তেমনি মহাকাশের বাণিজ্যিকীকরণের ফলে ইতোমধ্যেই মহাকাশকে জঞ্জালপূর্ণ, বিপদ সঙ্কুল একটি স্থানে পরিণত করেছি।
নাসার দেওয়া তথ্য অনুযায়ি, নিম্ন কক্ষপথে লক্ষ লক্ষ টুকরো ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এবং সেগুলো ১৮ হাজার মাইল অর্থাৎ বুলেটের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি গতিতে ছুটে চলছে। এগুলো মহাকাশ ভিত্তিক বিভিন্ন সেবা ও মহাকাশ অভিযানকে ব্যাহত করতে পারে। শুধু তাই নয়, অনেক সময় মহাকাশের জঞ্জাল পৃথিবীতে সরাসরি আঘাত হেনেছে।
কেসলার ইফেক্ট তত্ত্ব অনুযায়ী, যদি মহাকাশের একটিমাত্র বর্জ্য কোনো একটি উপগ্রহতে আঘাত হানে, তাহলে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং আরও অনেক উপগ্রহকে ধ্বংস করতে পারে। আসন্ন বড় কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে এখনই প্রয়োজনীয় মহাকাশ আইন তৈরি করতে হবে এবং আনুষাঙ্গিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এবার আসি মহাকাশ বাণিজ্যে আমাদের অবস্থানের বিষয়ে। মূলত এ মহাকাশ বাণিজ্য উন্নত দেশগুলো করে থাকে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এ খাতে অনেকটা পিছিয়ে। মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চা একটি ব্যয়বহুল বিষয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মহাকাশ একটি লাভজনক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রও বটে। মহাকাশ বাণিজ্যে প্রবেশ করার জন্য মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চা আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় বৃহৎ পরিসরে এটা সম্ভব নয়। তবে আমাদের মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চা এখনই শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৫৪ বছর। এই ৫৪ বছরে মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চায় তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। যদিও স্যাটেলাইট প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ মহাকাশ বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করেছে। এ বাণিজ্যে লাভের বদলে বছরে ৬৬ কোটি টাকা করে লোকসান গুণতে হয়েছে। এর কারণ হিসেবে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক খলিলুর রহমান স্যাটেলাইট ব্যবহারের জন্য সঠিক ব্যবহারিক পরিকল্পনা না করা ও অদক্ষতাকে দায়ী করেছেন।
মহাকাশকে কেন্দ্র করে, রকেট, রোবট এবং নানা প্রযুক্তিগত কাজ রয়েছে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, মহাকাশ ইন্ডাস্ট্রি একটি বড় বাণিজ্যের ক্ষেত্র। ওয়ার্ড ইকোনমিক ফোরাম থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মহাকাশ এক নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্যাটেলাইট এবং রকেট-চালিত প্রযুক্তি আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে মহাকাশ অর্থনীতি ২০৩৫ সালের মধ্যে ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ প্রতিবেদন থেকে বোঝাই যাচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে মহাকাশ বাণিজ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই আপাতত স্বল্প পরিসরে হলেও যথাযথভাবে মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চা শুরু করা আবশ্যক। বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানকে (স্পারসো) নতুন নতুন গবেষণা প্রকল্প হাতে নিতে হবে। মহাকাশ গবেষণার জন্য দেশে অন্তত একটি ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে।
দেশের বাইরে যেসব বাঙালি মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে, তাদের দেশের কল্যাণে মহাকাশ গবেষণার জন্য নব্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগদানের আহ্বান জানাতে হবে। তবে হতাশার বিষয়, বাংলাদেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই আন্তর্জাতিক মান নেই। সেখানে মহাকাশ বিজ্ঞানের মতো জটিল ও ব্যয়বহুল বিষয় চর্চার জন্য নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা অনেক শক্ত কাজ। তবে দেশের সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই সম্ভব।
ভবিষ্যতে বিশ্ব বাণিজ্য অনেকটা মহাকাশ কেন্দ্রীক। প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ গড়তে হলে আমাদের এখনই মহাকাশ বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে জাতি প্রযুক্তিগতভাবে যতবেশি উন্নত, সেই জাতি অর্থনৈতিকভাবে ততবেশি শক্তিশালী।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
/মেহেদী/