ঢাকা     বুধবার   ১৬ অক্টোবর ২০২৪ ||  কার্তিক ০ ১৪৩১

ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জ

রুশাইদ আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২২, ১৬ অক্টোবর ২০২৪  
ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জ

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ থেকে প্রায় ৫৩ বছর আগে বিশ্বের বুকে ভূমিষ্ঠ হয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই বাংলাদেশ তথা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো।

পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকায় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় উদ্দীপ্ত হওয়ায় স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার নীতি গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার খাতিরে একই পথে হাঁটে চীনও। এর বিপরীতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন (অধুনা রাশিয়া) ও আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশ অবস্থান নেয় বাংলাদেশের পক্ষে। 

আপাত দৃষ্টিতে তখন বিশ্বের মোড়লদের বাংলাদেশের পক্ষ নেওয়া বা না নেওয়ার ক্ষেত্রে জোটকেন্দ্রিক প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ ঘরানার পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সূত্র ধরে ক্রমে ক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অন্যান্য দেশও ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত প্রায় দেড় লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যাবিশিষ্ট এ ক্ষুদ্র বদ্বীপটির হঠাৎ করে বিশ্বের ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে আসল রহস্য বা কারণগুলো কী? এ প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে আলোকপাত করা যাক্।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান

ভূরাজনৈতিকভাবে বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে প্রথম রহস্য হলো এর ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের গোটা পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তজুড়ে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। পাশাপাশি, উত্তরে আরও আছে আসাম ও মেঘালয়। পূর্বে রয়েছে আসামের কিয়দংশ, ত্রিপুরা ও মিজোরাম প্রদেশ। আর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের পরিব্যাপ্তি, যা ব্যবহার করে সারা বছর সমগ্র বিশ্বের অর্ধেক বাণিজ্যিক পণ্য পরিবাহিত হয়ে থাকে।

ভারত মূলত বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তার অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সংবলিত সাত অঙ্গরাজ্য তথা সেভেন সিস্টার্স বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে থাকায়। কেননা ঢাকার সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ব্যতীত দেশটির আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয়, অরুণাচল, ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রেখে রাজ্যগুলোর বাসিন্দাদের অন্তরে পুঞ্জীভূত চাপা ক্ষোভ সামাল দিয়ে শাসন জারি রাখা অতটাও সহজ নয়।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ভারতের ‘চিকেন নেক’ খ্যাত শিলিগুড়ি করিডর ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী প্রধান অঞ্চল। এ অংশটি চীন সীমান্তেরও নিকটবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে এক সংযোগস্থলে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যেই চীন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরই) প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।

অপর দিকে, ভৌগোলিক কারণে মার্কিন এবং রুশ ব্লকের ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশকে প্রাধান্য দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো দক্ষিণ এশিয়ায় নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ন্যাটোভুক্ত বিভিন্ন মিত্রদেশের জলসীমায় নজরদারি করার জন্য সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করলেও, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এখনো তা করতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা ভালো সম্পর্ককে ব্যবহার করে যদি সেটি তারা করতে পারে, তা হবে তাদের জন্য বিশাল এক সফলতা। কারণ বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি থাকলে যে কোনো দেশই অনায়াসে ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেকটা অংশ পর্যন্ত তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখতে পারবে।

জনসংখ্যাও একটি নিয়ামক

ভূরাজনীতিতে জনসংখ্যা সর্বদাই একটি নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। কারণ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ১৮ কোটি ক্রেতার একটি বাজারে নিজেদের পণ্য সরবরাহ করার সুযোগকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কোনো উপায় নেই। ফলে বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশটির বাজারে পণ্য সরবরাহ করে নিজেদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে আরও বাড়িয়ে নিতে এশিয়ার উদীয়মান পরাশক্তি চীন থেকে শুরু করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের মতো দেশগুলো সর্বদাই সচেষ্টভাবে কাজ করে যেতে আগ্রহী। পাশাপাশি, প্রাচ্যের দেশ জাপান ও রাশিয়াও বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। যা ক্রমশ ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে নিশ্চিতভাবে।

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক তৎপরতা

স্বাধীনতা লাভের পর ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’— এ ঘরানার পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুরু করে। তবে ৭০’র দশকের প্রথম দিকে সোভিয়েত বা রুশ ব্লকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলায় বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশেষত মার্কিনদের বিরাগভাজন হলেও, ওই দশকের মাঝামাঝি ঘটনাবহুল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে দেশের সব সামরিক ও বেসামরিক সরকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স তথা পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে কাজ শুরু করে। পাশাপাশি, ভারত, রাশিয়া, চীন, জাপানও বাংলাদেশের সঙ্গে স্থাপন করে সৌহার্দ্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ও অংশীদার হয় দেশের নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্পের।

একইসঙ্গে বিশ্বের দুই প্রভাবশালী ভূরাজনৈতিক বলয়ের দেশগুলোর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ কূটনৈতিক ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক অটুট রাখায় অর্থনৈতিক, আবাসন, শিল্পোৎপাদনসহ নানা খাতে ছোট-বড় প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক ঘোড়ায় রূপান্তরিত হয়েছে।

বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক উথানে রোহিঙ্গা

২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির তৎকালীন ক্ষমতাসীন সূচি সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরুর নামে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করলে জনগোষ্ঠীটির ১১ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। অভিবাসনের প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হতে চললেও মিয়ানমার অদ্যাবধি তাদের ফিরিয়ে নেয়নি।

রাখাইনও ভারত ও চীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক স্পট। উত্তর রাখাইনের নিকটবর্তী মিজোরাম, ত্রিপুরা ও তার আশপাশের সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে ভারত মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে রাখাইনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতেও কাজ করছে তারা। কিন্তু রাখাইনের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ এবং আরাকান আর্মিরা শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে।

এর সঙ্গে চীনও তাদের বেল্ট অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভ পরিকল্পনা কার্যকর করতে রাখাইনের কাচিয়াপু ও মাড় দ্বীপের নিকটবর্তী গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে সয়ে গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলন করে মিয়ানমারের মান্দানম হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত সরবরাহ করছে। পাশাপাশি, প্রাচ্যের দেশ জাপানও রাখাইনের মংডুর কাছাকাছি অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে বিনিয়োগ করছে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর যে ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা দরকার, তা থেকে বাংলাদেশকে চীন, ভারত ও জাপানের মতো অংশীদাররা পরোক্ষভাবে নিরুৎসাহিত করছে নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে।

আমাদের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়

বিংশ শতাব্দীর মার্কিন নৌ-তত্ত্ববিদ ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাডমিরাল থায়ার মাহান বলেছিলেন, ‘এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের সবচেয়ে বড় উপায় হলো ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব ধরে রাখা।’ সেই সূত্র ধরে ভারত মহাসাগর ও তৎসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরসহ অন্যান্য সমুদ্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিশ্বের ভৌগোলিক পরাশক্তিগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য মুখিয়ে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কিংবা যে কোনো দেশের জলসীমার মধ্যে এ ধরনের কর্তৃত্ব স্থাপন সেই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকির সৃষ্টি করবে নিঃসন্দেহে।

এছাড়া, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে যুগপৎভাবে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখায় এ সম্পর্কগুলোর মধ্যে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ ঘরানার ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। কেননা কোনো একটি নির্দিষ্ট ব্লকের দিকে ঝুঁকে পড়লে অপর ব্লক থেকে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক যে চাপ আসতে পারে, তা সামলানোর সক্ষমতা এখনো বাংলাদেশ অর্জন করেছে কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অধিকন্তু, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে এখনো তরুণ প্রজন্মকে ভূরাজনীতিতে সচেতন করে গড়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচ সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছেন। তাই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখতে এ প্রসঙ্গে আমাদের বিস্তর অধ্যয়ন করা এবং যে কোনো উদ্ভূত সমস্যা বা সংকট সমাধানে দক্ষতা অর্জন করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়