ঢাকা     মঙ্গলবার   ২২ অক্টোবর ২০২৪ ||  কার্তিক ৬ ১৪৩১

অবমূল্যায়ন থেকে মুক্তি পাক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

তানজিদ শুভ্র || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৬, ২২ অক্টোবর ২০২৪  
অবমূল্যায়ন থেকে মুক্তি পাক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এর বিস্তৃতি বাংলাদেশের মানচিত্রসম। সারাদেশে বিস্তৃত ২ হাজার ২৫৭টি কলেজে ৩৫ লক্ষ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর গাজীপুরের বোর্ড বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আবেগ, ভালোবাসা আর মায়া জড়িয়ে আছে দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর হৃদয়ে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক (সম্মান), তিন বছর মেয়াদি স্নাতক (পাস) এবং চার বছর মেয়াদি স্নাতক (সম্মান) প্রফেশনাল কোর্স রয়েছে। এছাড়া এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর কোর্সও চালু করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ও এমফিলের ব্যবস্থাও আছে।

উচ্চশিক্ষাকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখাতে এবং জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে যুক্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী তালিকাভুক্তি অনুসারে এটি দেশের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়া তোলা এর মূল লক্ষ্য। তবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন, অপর্যাপ্ত ক্লাস, ব্যবহারিক ক্লাসের কমতি, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিতি, ইনকোর্স পরীক্ষা ও সমাবর্তন না হওয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে রয়েছে শিক্ষার্থীদের অভিমান, অনুযোগ। প্রতিষ্ঠার তিন দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো এ বিষয়গুলোর সমাধান হয়নি। বরং দিন দিন যেন জটিলতা বাড়ছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ফলাফল প্রকাশে সার্ভার জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি। কিছুদিন আগে ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অধিভুক্ত কলেজ থেকেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে দিনদিন। করোনাকালে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চালু রাখতে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়। ওই সময়ের রেকর্ডকৃত ক্লাসসমূহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য মূল্যবান রিসোর্স কন্টেন্ট।

পাশাপাশি অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য দেওয়া হয়েছে ই-লাইব্রেরির সুবিধা। এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পড়তে পারবে এবং দেখতে পারবে বিষয়ভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল, কন্টেন্ট। ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা, শিক্ষার্থীদের জন্য অফিসিয়াল ডোমেইনে বরাদ্দ করা হয়েছে ই-মেইল ঠিকানা।

শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষের। অনেক সময় দেখা যায়, যারা ক্লাস করতে চায় না তাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরামর্শ দেয় অনেকে। অর্থাৎ পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই যেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে পর্যাপ্ত ক্লাসের অভাব, শিক্ষক সংকটসহ নানা অবকাঠামোগত জটিলতায় যেমন নিয়মিত ক্লাসের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কলেজে, তেমনি ব্যাবহারিকের প্রতিও অনীহা দেখা যায় অনেক জায়গায়। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার এই যুগে ব্যবহারিক দক্ষতায় পিছিয়ে থেকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক পর্যাপ্ত ব্যবহারিক পাঠদান, মাঠকর্ম বিষয়ে তদারকি জরুরি। শুধু প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় সীমাবদ্ধ না থেকে যেন বাস্তব জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত উন্নতি সাধন হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি মানচিত্রসম এ প্রতিষ্ঠানের।

স্বায়ত্তশাসিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অনেকে এমনভাবে ছোট করে দেখে, এখানকার শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিচয় দিতে হীনমন্যতায় ভোগে। ২১ অক্টোবর, বিশ্ববিদ্যালয় দিবস সম্পর্কেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক, শিক্ষার্থী অবগত নন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ছোট করে দেখার মানসিকতা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে খোদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই বেশি।

পড়ুয়াদের মাঝে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানার ঘাটতি থাকতে পারে, কিংবা দায়িত্বশীলদের জানানোর আগ্রহের কমতি থাকতে পারে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও ইউজিসি অধিভুক্ত। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা করে সম্বোধন করে তফাত সৃষ্টি করা হয়। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষভিত্তিক চূড়ান্ত পরীক্ষা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় আরও বেশি স্বচ্ছ।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা হয় বোর্ড পরীক্ষার মতো। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ ক্যাম্পাসে পরীক্ষা দেওয়ার বিপরীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হয় অন্য কলেজে। পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষার্থীদের হাজিরা নেওয়া হচ্ছে খাতা স্ক্যানের মাধ্যমে সরাসরি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ভারে। অথচ অনেকেই একজন শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করেন অধ্যয়নরত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম শুনে। ভর্তি পরীক্ষায় অল্প নম্বরের ব্যবধানে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী এসব প্রেক্ষিতে নিজেকে ছোট মনে করে। এমনকি শিক্ষকরাও ভাবেন, তুলনামূলক কম মেধাবী বলেই এখানে ভর্তি হয়েছে। কখনো কখনো শিক্ষার্থীর পূর্বের শিক্ষাক্রমের ফলাফল দেখে শিক্ষকও অবাক হন। সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনা থেকে বের হয়ে মেধার মূল্যায়নে এ বৈষম্য নিরসন সময়ের দাবি।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অন্যতম আকাঙ্ক্ষিত একটি মুহূর্ত সমাবর্তন। আর সমাবর্তনের কথা ভাবলেই মাথায় আসে লম্বা আলখেল্লার মতো একটি কালো গাউন, একখানা হুড আর চারকোনা টুপির কথা। যে টুপি হাওয়ায় উড়িয়েই স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা জানান দেন নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক বিজয়ের। এ ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সমাবর্তন অনেকটাই ছুঁয়ে দেখতে না পারা একটি স্বপ্ন।

২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন। এরপর ২০২০ সালে আয়োজনের কথা থাকলেও কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপরও অনেকদিন গত হলো, কিন্তু সমাবর্তন নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নতুন উপাচার্য যোগদানের পর শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন সমাবর্তন আয়োজন করার। শিক্ষার্থীদের এ দাবি কবে বাস্তবায়ন হয়, তা দেখার অপেক্ষা।

অবমূল্যায়ন আর অবহেলা থেকে মুক্তি পাক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ুক দেশব্যাপী। যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের, তার পূর্ণতা পাক দক্ষ জনশক্তি বিনির্মাণের মাধ্যমে।

লেখক: শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়