প্রকৃতিতে নেমেছে শীতের আমেজ
ফারজানা ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
গ্রামের শীতের সকাল। ছবি: সানজিদা পিংকি
ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচিত আমাদের এই বাংলাদেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত- এ ছয়টি ঋতু প্রতিবছর আসে পালাক্রমে। প্রতিটি ঋতুর স্থায়ীত্ব দুই মাস করে। তবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে ঋতুর সময়ের হিসাবের সঙ্গে বৈশিষ্ঠ্যের গড়মিলও দেখা যাচ্ছে।
ষড়ঋতুর এ দেশের মানুষের কাছে শীত একটি জনপ্রিয় ঋতু। পৌষ ও মাঘ মাস মিলে হয় শীতকাল, যা প্রকৃতির এক অনন্য রূপের বদল পরিলক্ষিত হয়। আমাদের জীবনধারায় যুক্ত করে এক অন্য মাত্রা।
শিশিরভেজা ধানক্ষেত চিকচিক করে সকালের সোনালী আলোই। ছবি: সানজিদা পিংকি
শীতকালে শিশিরভেজা ঘাস, ফসলের ক্ষেত, গাছপালা, কুয়াশায় ঢাকা প্রকৃতি এক অন্যরকম রূপ দেয়। শীতের জবুথবু সকালের জড়তা কেটে যায় সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। সকালের মিষ্টি রোদে প্রকৃতি যেন জেগে উঠতে শুরু করে, দুপুরে রৌদ্রখরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মৃদুমন্দ বাতাসে আন্দোলিত হতে থাকে গাছ-গাছালি। গোধূলি থেকে আবার শুরু হয় প্রকৃতির জড়তা। এ যেন নিত্যদিনের খেলা।
এ দেশের অনেকেই হতদরিদ্র। এজন্য শীতকাল তাদের জন্য আরামদায়ক হয়ে ওঠে না। আবার সচ্ছলদের জন্য এটা বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। শীতের সকালের কুয়াশা, মিষ্টি রোদ, আর ঠান্ডা হাওয়া এক অসাধারণ আরামদায়ক অনুভূতি নিয়ে আসে তাদের। এ সময় প্রকৃতির চারপাশে এক মিষ্টি পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গ্রীষ্মের তীব্র গরমের পরে শীতের শীতল আবহাওয়া একরকম স্বস্তি নিয়ে আসে। বাজারে গরম কাপড় বিক্রির ধুম পড়ে যায়, দেখা মেলে অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ীদের।
কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের কিরণ ভেসে ওঠতেই মাঠভরা হলুদ সরিষা ক্ষেত, নদী-হাওড়-খাল-বিলসহ নানা জলাশয়ে পরিযায়ী পাখির সমারোহ, শিমুলসহ বিভিন্ন গাছের ডালে পাখিদের কলকাকলি, ফুলে ফুলে নানা কীটপতঙ্গের ছোটাছুটি, রাতের আকাশভরা তারা, জ্যোৎস্নাশোভিত রাত সবাইকে মোহনীয় করে তোলে। শীতকাল তার নিজস্ব সৌন্দর্যের মাধ্যমে মানুষকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে আসে।
এ যেন উৎসবের ঋতু। পুরো শীতকাল জুড়ে পিঠা উৎসবসহ নানা ধর্মীয়, পারিবারিক ও সামাজিক উৎসব লেগেই থাকে। শীতের স্বাভাবিক ঠাণ্ডা পরিবেশ, খেজুরের রস, পিঠাপুলি এবং বিভিন্ন আয়োজন শীতকে করে তোলে আরো আনন্দময়। যেন খেজুরের রস আর গুড়ের জন্য সারাবছর মানুষ এ ঋতুর জন্যই অপেক্ষা করে।
এ সময়ে পিঠাপুলি, পাটিসাপটা, ভাপা, দুধপুলি, চিতই, রস মঞ্জুরি, ঝাল পাটিসাপটা, খোলা ঝালি পিঠা, নারকেল নাড়ু, বাঁশবোশা, তেলপিঠা, ডিম পোয়া, নারকেল, নোনাসসহ বিভিন্ন পিঠার দেখা মেলে। বিভিন্ন স্থানে পিঠা মেলারও আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ এলাকায় ১৮০ ধরনের পিঠা নিয়ে উৎসব ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
সকাল হতেই মাঠে গরু নিয়ে যাচ্ছেন কৃষাণী। ছবি: সানজিদা পিংকি
পৌষ-পার্বণ বাংলা ঐতিহ্যের একটি বড় উৎসব। নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পিঠা নিয়ে এই উৎসব পালিত হয়। বসন্ত বরণ উৎসবও দেখা মেলে শীতে। অবশ্য শীতের শেষ সময়ে এর দেখা মেলে। এছাড়া শীতকালে বিভিন্ন স্থানে মেলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। এসব শীতকালীন উৎসব শুধু আনন্দের নয়, আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
শীতকাল ভ্রমণের জন্য একটি আদর্শ সময়। বাংলাদেশে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত আবহাওয়া ঠান্ডা ও শুষ্ক হওয়ায় ভ্রমণের জন্য আরামদায়ক। সিলেটের চা বাগান, জাফলং, বিছানাকান্দি, রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল, স্বর্ণ মন্দির, বগালেক, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝর্ণা, সুন্দরবনের বাঘের অভয়ারণ্য, নদী ভ্রমণ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, ইনানি বিচ, হিমছড়ি, সেন্ট মার্টিন, নীল জল ইত্যাদি ভ্রমণ কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের উপচে পড়া ভীড় লক্ষ্যনীয়।
শীতকাল নির্দিষ্ট কিছু সবজি ও ফসলের জন্য খুবই উপযোগী হওয়ায় কৃষকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দেয়। এ সময়ে বোরো ধান, গম, আলু, ডাল জাতীয় শস্য মসুর, খেসারি, মুগ, তেলজাতীয় ফসল সরিষা, তিল, শাকসবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, গাজর, টমেটো, লাউ, মসলার মধ্যে রসুন, পেঁয়াজ, আদা প্রভৃতি উৎপাদন হয়। কম তাপমাত্রা ও শীতের আবহ এসব ফসলের গুণগত মান উন্নত করে। শীতকালীন কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শীত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, উৎসব ও খাবার-দাবারের বৈচিত্র্য দিয়ে সবার মন জয় করে। এটি শুধু আবহাওয়া নয়, এক জীবন্ত অনুভূতি।
(লেখক: শিক্ষার্থী ও ফিচার লেখক, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী)
ঢাকা/মেহেদী