ঢাকা     বুধবার   ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ১৮ ১৪৩১

জবি প্রশাসনের ১০০ দিন: দ্বিতীয় ক্যাম্পাস যেন কথার কথা

লিমন ইসলাম, জবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৩:০১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
জবি প্রশাসনের ১০০ দিন: দ্বিতীয় ক্যাম্পাস যেন কথার কথা

ঢাকা কেরানিগঞ্জের তেঘরিয়ায় প্রায় ২০০ একর জমির উপর নির্মিত হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। নতুন এ ক্যাম্পাস নিমার্ণের জন্য গেল ৬ বছরে তিনবার মেয়াদ বাড়িয়েও হয়নি দৃশ্যমান কোনো স্থাপনা।

জুলাই বিল্পবের পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মাঝে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস বাস্তবায়নের আশা জেগেছিল। কিন্তু তার দায়িত্ব নেওয়ার ১০০ দিনেও কাজের তেমন অগ্রগতি পাওয়া যায়নি।

জমি অধিগ্রহণ ও প্রাচীর নির্মানেই আটকে আছে উন্নয়ন কাজ। রয়েছে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবাসিক হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় তৎতকালীন সরকার। অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসিক হল, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, মেডিকেল সেন্টার, সুইমিংপুল, লেক নির্মাণসহ উন্নতমানের ক্যাম্পাস তৈরির লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। একই বছর ৯ অক্টোবর ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য  প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্পটির জন্য ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার।

২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মোট ২০০ একর জমির মধ্যে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি বুঝে পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও বাকি ১১ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আবার ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় থমকে আছে জমি ভরাটের কাজও। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য জানিয়েছেন, কিছুদিনের মধ্যেই ১১ একর জমি পাওয়া যাবে।

জানা গেছে, ৬১ কোটি ৮৯ লাখ ৯ হাজার ৩৪৭ টাকায় এসএসএল ও আরএস নামক দুইটি প্রতিষ্ঠান নতুন ক্যাম্পাসে যৌথভাবে পাঁচতলা প্রকৌশল ভবনের টেন্ডার পায়। অন্যদিকে, ৩ কোটি ২৮ লাখ ৩৪ হাজার ৫১৪ টাকায় নতুন ক্যাম্পাসের পুকুরের ঘাট করার টেন্ডার পায় আরএন এন্টারপ্রাইজ নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এখানেও রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। 

দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের প্রাচীর কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করার কথা থাকলেও ইট দিয়েই তা সম্পন্ন করা হয়েছে। নতুন ক্যাম্পাসে লেক খননের জন্য ইউআইএডিএল (জেভি) কোম্পানিকে ২৪ কোটি টাকায় টেন্ডার দেওয়া হয়। তবে খনন কাজের শেষ দিকে আরো ৮ কোটি টাকা সংস্কার (রিভাইস) বাজেট দেওয়া হয়। টেন্ডারের অতিরিক্ত টাকা নিয়েও হস্তান্তরের আগেই লেকের বেহাল অবস্থা দেখা দিয়েছে।

সরজমিনে দেখা যায়, লেকের চারদিকের পাড় ভেঙে পানিতে ধসে পড়েছে। পাড় সুরক্ষায় সাদা এক ধরনের কাপড়ের পর্দা দিলেও আটকানো যাচ্ছে না মাটি। পর্দার নিচ থেকেই মাটি ধসে পানিতে চলে যাচ্ছে। প্রাচীরের কাজও করা হয়েছে দায়সারাভাবে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনিয়ম দূর্নীতির কারণেই নতুন ক্যাম্পাসের কাজের দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান বলেন, “ছয় বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসে দৃশ্যমান উন্নয়নের অভাবের কারণ হতে পারে আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব, দুর্নীতি, জমি অধিগ্রহণ সমস্যা, রাজনৈতিক পরিবর্তন বা নির্মাণে বাধা। আমরা জানি, আমাদের প্রশাসন তাদের কাজ সঠিকভাবে করেনি। তারা চাইলে, তাদের কাছে দৃশ্যমান অবকাঠামোর অনেক পথ ছিল।”

তিনি বলেন, “এটি সমাধানের জন্য, প্রক্রিয়াগুলোকে স্ট্রীমলাইন, স্থিতিশীল তহবিল সংরক্ষণ, জমি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান, প্রকল্প পরিচালনার উন্নতি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করুন। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে স্পষ্ট কথা বলার সময় এসেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর জন্য তাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।”

ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি একেএম রাকিব বলেন, “সর্বশেষ ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার আগে উপাচার্যের সঙ্গে কথা হলে তিনি দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে ইচ্ছে পোষণ করেননি। তিনি কাজ চলছে বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন মাস দায়িত্বে থাকার পর তার কাছ থেকে কাজের কোন ডেডলাইন পাইনি। আগামীকাল ক্যাম্পাস খুললে তিনি দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের আপডেট না জানালে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা পরবর্তী পদক্ষেপ জানাব।”

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সদস্য সচিব মুজাহিদ বাপ্পী বলেন, “দুই দশক পেরিয়ে গেলেও ন্যূনতম আবাসনসহ মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কারণে ৮ বছর পার হলেও ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। প্রশাসনিক পদে উল্লেখযোগ্য রদবদল হলেও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে বহাল রয়েছেন।”

তিনি বলেন, “বরাবরের মতো আমরা প্রতিশ্রুতি শুনি। কিন্তু কোন বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। সার্বিকভাবে প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।”

নতুন ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ আলি আহমেদ বলেন, “ভূমি উন্নয়ন ও ভবন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। শিগগিরই কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশাবাদী।”

উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম রাইজিংবিডিকে বলেন, “জুলাই বিল্পবের আগে গত প্রশাসন আমাদের প্রকল্পটি তো বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে আমরা তাদের প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করি। ফলে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।”

তিনি বলেন, “পূর্বে যে কাজ করা হয়েছিল, সেখানে জমির চেয়ে রাস্তা বেশি রাখা হয়েছিল। ব্রিজগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল যে, এর নিচ দিয়ে কোনো জলযান যেতে পারবে না। এ খবর পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ডিপিপি সংশোধন করার জন্য বলে। আমরা অলরেডি কাজ শুরু করে দিয়েছি। যেহেতু এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া, তাই একটু সময় লাগবে।”

পুকুর খননের এবং ১১ একর জমি অধিগ্রহণ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, “পুকুরের ঘাট নির্মাণের কাজ চলছে। লেকের কাজ শেষ। তবে কাজ শেষ হওয়ার পরেও লেকের পাড় ভেঙে যাচ্ছে। আমাদের বালু ভরাটের কাজটি চলমান রয়েছে। আর জমি অধিগ্রহণের জন্য সম্পূর্ণ কার্যক্রম শেষ। এখন আমরা টাকা দিলেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।”

দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা তো সরাসরি পিডি নিয়োগ দিতে পারি না। পিডি নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে হয় এবং নিয়োগ দেয় ইউজিসি। আমরা সংশ্লিষ্ট আর্মড ফোর্স ডিভিশনকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করার জন্য বলেছিলাম। তারা আমাদের বলেছে, ইউজিসির মাধ্যমে তাদের কাছে চিঠি পাঠাতে। আমরা ইউজিসিকে চিঠি দিয়েছি। এখন ইউজিসি আর্মড ফোর্স ডিভিশনকে চিঠি দিলেই পিডি নিয়োগের কাজ শুরু করতে পারব।

৭০০ শিক্ষার্থীর আবাসন নিয়ে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, “শিক্ষার্থীরা কীভাবে থাকবে, সেটা নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ণের কাজ চলমান। আশা করি এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই আমরা শিক্ষার্থী নির্বাচনের কাজ শুরু করতে পারব।”

২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৫’ পাশের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনুমোদিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাথমিকভাবে ২২টি বিভাগসহ চারটি অনুষদে শিক্ষার্থীদের নথিভুক্ত করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ একরের প্রথম ক্যাম্পাসে ১১টি ভবন, একটি শহীদ মিনার এবং ‘১৯৭১সালের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ শীর্ষক একটি ভাস্কর্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ছয়টি অনুষদ, ৩৮টি বিভাগ এবং দুটি ইনস্টিটিউটের অধীনে প্রায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থী ও ৭০০ শিক্ষক রয়েছে। মহিলা শিক্ষার্থীদের জন্য একমাত্র বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল রয়েছে।

ঢাকা/মেহেদী


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়