বেসরকারির মধ্যে প্রথম আন্দোলনে নামে গণ বিশ্ববিদ্যালয়
সানজিদা জান্নাত পিংকি, গবি || রাইজিংবিডি.কম
২০২৪ সালটি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি অনন্য অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সারা বছরই নানা সংকটময় ঘটনার সম্মুখীন হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি এটি ছিল পরিবর্তন, অগ্রগতি এবং শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের পথে এক সাহসী পদক্ষেপের বছর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা, বৈষম্যেবিরোধী আন্দোলন এবং বহুল প্রতীক্ষিত সমাবর্তনের উদ্যোগ—সবই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সায়েন্টিফিক পোস্টার প্রেজেন্টেশন থেকে শুরু করে উত্তাল গণ-আন্দোলন, ক্যাম্পাস সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাগুলো বছরের পরতে পরতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।
প্রথম সায়েন্টিফিক পোস্টার প্রেজেন্টেশন
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাল্টিডিসিপ্লিনারী রিসার্চ (সিএমআর) এর উদ্যোগে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় সায়েন্টিফিক পোস্টার প্রেজেন্টেশন। এতে মোট ২২টি গবেষণা কর্মের ফলাফলের পোস্টার প্রদর্শিত হয়। পাশাপাশি এসব গবেষণাগুলোর সারসংক্ষেপ বই উন্মুক্ত করা হয়। ৬৮ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এ গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন। সেরা পাঁচ পোস্টার প্রেজেন্টেশনকারীকে পুরস্কৃত করা হয়।
১০ বছর পর সমার্তনের প্রস্তুতি
দীর্ঘ ১০ বছর পর চতুর্থ সমাবর্তন আয়োজনের লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করে গবি। সমাবর্তনের ঘোষণার পর নিবন্ধন ফি নিয়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। এরপর তারিখ ঘোষণা ছাড়াই নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরুর পর স্থবির হয়ে যায় বহুল প্রতিক্ষীত এ সমাবর্তনের প্রস্তুতি। অন্তত দুই দফায় নিবন্ধনের তারিখ বৃদ্ধির পর নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পর কোনরকম নোটিশ না আসায় বেশ সমালোচনা শুরু হয় এই সমাবর্তনকে ঘিরে।
ছাত্র জনতার আন্দোলন এবং সরকার পতনের মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে শুরু হওয়া অস্থিরতার কারণে ইউজিসি কর্তৃক স্থগিত রাখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাবর্তন কার্যক্রম। সবশেষ পুনরায় কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বহুল প্রতিক্ষিত এই সমাবর্তনের সম্ভাব্য সময় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি জানান গবি উপাচার্য।
রেজিস্ট্রার কাণ্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার এস. তাসাদ্দেক আহমেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে দূর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আসে। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে তাদের উপর হামলার অভিযোগ ওঠে সাবেক এ রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলার অভিযোগ ওঠে আইন বিভাগের শিক্ষক লিমন হোসেন ও তার সমর্থক গোষ্ঠীর উপর। এতে আহত হন রাজনীতি প্রশাসনের শিক্ষার্থী আবিদ হোসেন। পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের চাপে কর্মস্থল ত্যাগে বাধ্য হন এস. তাসাদ্দেক আহমেদ। পরবর্তীতে সিন্ডিকেট সভায় তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতিসহ অন্যান্য অভিযোগের প্রমাণ সাপেক্ষে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে আবু মুহাম্মাদ মুকাম্মেলকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
ক্যাম্পাসের নিরাপত্তায় নোটিশ
কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসের সার্বিক শৃঙ্খলা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতকরণে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রশাসন। বিজ্ঞপ্তিতে সবাইকে পরিচয়পত্র প্রর্দশন ও পরিধান, প্রতিটি ফ্লোরে মনিটরিং কমিটি গঠন, ক্যাম্পাসে যেকোন আয়োজনে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া, অসুস্থতা বা বিশেষ কারণ ছাড়া ক্যাম্পাসে রিকশা বা অটো রিকশা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ ছাড়া অতিথি ও দর্শনার্থীর ক্ষেত্রে তার বিস্তারিত তথ্যাদি লিপিবদ্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ফুটবল খেলা নিয়ে মারামারি
আন্তঃবিভাগ ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে দফায় দফায় মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে আহত অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে তিনজনের অবস্থা খুবই গুরুতর হয়। এ ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ফুটবল টুর্নামেন্ট স্থগিত করে গবি প্রশাসন। এছাড়াও মারামারির ঘটনার সুষ্ঠু সমাধানের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রশাসন।
মারামারির ঘটনায় সংবাদ প্রকাশ করায় ঘটনার পরদিন বিক্ষুব্ধ কিছু শিক্ষার্থী গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (গবিসাস) কার্যালয়ের সামনে জমায়েত সৃষ্টি করে সংগঠন বন্ধ ও তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার হুমকি এবং ক্ষমা চাওয়ার আল্টিমেটাম দেয়। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, যা আজো চলমান।
জুলাই আন্দোলনে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে সারাদেশে বিক্ষিপ্তভাবে ভূমিকা পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের শুরুর দিকে মাত্র ১১ জন শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদানের সূচনা করে গবি শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে ৩৬ দিনের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল শতভাগ। এ সময় সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার, আহতও হন তারা।
ট্রাস্টিবোর্ডের সাফল্য
সরকার পতনের পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ট্রাস্টি মনোনয়ন পান। তারা হলেন - সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ড. আসিফ নজরুল ও ফরিদা আখতার। এছাড়াও গবি অন্যতম ট্রাস্টি সদস্য শিরিন হককে প্রধান করে গঠিত হয় নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। এছাড়াও বেগম রোকেয়া পদক ২০২৪ এ ভূষিত হয়েছেন তিনি।
ক্যাম্পাস সংস্কার আন্দোলন
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন ও তার সমাজভিত্তিক চিন্তাকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ২১ দফা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে আরেক সভা শেষে ২১ দফাকে দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে সাত দফায় রূপান্তরিত করে প্রশাসনকে ৭ মিনিটে নিচে নামতে বাধ্য করে ছাত্র প্রতিনিধিরা। শিক্ষার্থীদের দাবিকে যৌক্তিক চিহ্নিত করে দ্রুতই তা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন। একই দিনে শিক্ষার্থীদের পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেন বিভিন্ন অনুষদের ডিন এবং বিভাগীয় প্রধানরা।
এরই প্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আবু মুহাম্মদ মুকাম্মেল স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে সংস্কারপন্থীদের সমর্থন জানিয়ে, অভিযুক্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা, ওয়েভার পদ্ধতি সংস্কার, জরিমানা প্রথা নিরসন, নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ সার্বিক নিরপত্তা নিশ্চিত, ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণের কাজ দ্রুত শুরুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে জরিমানা প্রথায় সংস্কার হলেও বাকি বিষয়ে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
উত্তাল জুলাই
‘উত্তাল জুলাই’ শিরোনামে গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (গবিসাস) আয়োজনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আলোকচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী হয়। এতে গবিসাসের সম্পাদনায় শিক্ষার্থীদের তোলা অভ্যুত্থানের আলোকচিত্র, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ভিডিও সমন্বিত সব প্রামাণ্যচিত্র দিনব্যাপী প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৯) সারা পৃথিবী থেকে ৩২ হাজার জলবায়ু আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীদের মাঝে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী এসএম শাহিন আলম। এ ছাড়া উত্তপ্ত বছরের শেষে প্রশান্তি আনে গবি শিক্ষক মোখলেছুর মন্ডল। মেডিকেল ফিজিক্সের এ শিক্ষক ২৪তম এশিয়া-ওশেনিয়া কংগ্রেস অফ মেডিকেল ফিজিক্স এবং ২২তম সাউথ-ইস্ট এশিয়া কংগ্রেস অফ মেডিক্যাল ফিজিক্স সম্মেলনে তার দুটি গবেষণা পত্র উত্থাপন করে ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।
ঢাকা/মেহেদী