ঢাকা     শনিবার   ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২০ ১৪৩১

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

১% পোষ্য কোটা নিয়ে উপাচার্যের ব্যাখ্যা, প্রত্যাখ্যান করে আল্টিমেটাম

রাবি সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০০:২৬, ২ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ০০:২৭, ২ জানুয়ারি ২০২৫
১% পোষ্য কোটা নিয়ে উপাচার্যের ব্যাখ্যা, প্রত্যাখ্যান করে আল্টিমেটাম

রাবি উপাচার্যের ব্যাখ্যা (বামে) ও সংবাদ সম্মেলনে বেষম্যবিরোধীরা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) শিক্ষক ও কর্মকতাদের সন্তানদের কোটা বাতিল করে সহায়ক ও সাধারণ কর্মচারীদের পুত্র-কন্যাদের জন্য ১ শতাংশ কোটা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।

এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব তার ফেসবুকে ১ শতাংশ কোটার ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে এবং কোটার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আল্টিমেটাম দিয়েছেন।

বুধবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত ভর্তি কমিটির জরুরি সভায় ১ শতাংশ পোষ্য কোটার এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কমিটির সভাপতি উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব সভায় সভাপতিত্ব করেন।

গত দুই মাস ধরে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধন থেকে শুরু করে আমরণ অনশন কর্মসূচিও পালন করেছেন তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভর্তি কমিটির জরুরি সভার আয়োজন করে।

কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আসন্ন ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় কেবল সহায়ক ও সাধারণ কর্মচারীদের পুত্র-কন্যাদের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এতে শিক্ষক ও কর্মকতাদের সন্তানদের কোটা বাতিল করা হয়েছে।

প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, “প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম। ১ শতাংশও পোষ্য কোটায় আসন বরাদ্দ রাখতে দেব না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বাবার দৈনিক ইনকাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। তাদের থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী না কর্মচারীরা।”

তিনি শহিদের কসম নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “প্রশাসনের হাতে এখনো ১৬ ঘণ্টা সময় আছে ভাবার জন্য। এরপর আর সময় দেওয়া হবে না। জাস্ট ১০টায় অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রশাসনিক ভবনে তালা দেওয়া হবে। পোষ্য কোটা বাতিল না হলে অচল করে দেব এই রাবি; শহীদের কসম।”

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের ফেসবুক টাইমলাইনে পোষ্য কোটাবিরোধী পোস্ট দিতে থাকেন। এ কোটার বিরুদ্ধে এক রকম ফুঁসে উঠেছেন রাবি শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহা. ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, “ভর্তি কমিটি মনে করেছে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সন্তানদের ১ শতাংশ কোটা রাখা যৌক্তিক। নানা কারণে তারাও বঞ্চিত। যদিও তারা অনগ্রসর না। তবে অন্তত কিছুটা হলেও তারা পিছিয়ে পড়া। তাদের যে আয়, তাতে তাদের সন্তানদের বাইরে পড়ানো সম্ভব না। মানবিক কারণে তাদের ১ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে।  আমি শিক্ষার্থীদের অনুরোধ জানাচ্ছি, তারা যাতে এ দাবিটা মেনে নেয়।”

কোটা নিয়ে উপাচার্যের ব্যাখ্যা
নতুন এ সিদ্ধান্তের উপর নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব।

সেখানে তিনি লিখেছেন, “আজ প্রায় দু'মাস ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কোটা নিয়ে অস্থিরতা চলছে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ একটা সিদ্ধান্ত এসেছে। এতদিন বহু কথা বলার থাকলেও কিছু বলিনি। একটা দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সব কথা বলা যায় না। তবে আজ কিছু কথা বলতে হচ্ছে।”

কোটা রাখার কারণ হিসেবে তিনি আরও লিখেছেন, “প্রথমে পরিষ্কার করি আজ যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভর্তি উপকমিটির সকালে মিটিং ছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, শিক্ষক এবং কর্মকর্তা যারা কোনো বিচারেই অনগ্রসর শ্রেণিতে পড়েন না, তাদের জন্য আর কোটা সুবিধা থাকছে না। একেবারে লোয়ার লেভেলে যারা সার্ভিস দিচ্ছেন তাদের জন্য ১% কোটা এখন থাকছে। এর কারণটা বলি। আজ প্রায় ৩৪ বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। শুরু থেকেই দেখেছি, সুইপারের সন্তান সুইপার হচ্ছে, মালির ছেলে মালি। যদিও আমি প্রতিটি পেশাকে মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে করি। কিন্তু সমাজ আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে চলে না। আমি মনে করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এই শ্রেণিটির এই বৃত্ত ভাঙ্গার একটা সুযোগ এবারও থাকা উচিত।”

উপাচার্য লেখেন, “এই প্রস্তাবনা নিয়ে আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় ভর্তি কমিটির মিটিং ছিল। সেখানে আমার সম্মানিত সহকর্মিরা তাদের মতামত দিয়েছেন। তর্কবিতর্ক হয়েছে, পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভর্তি উপকমিটির সিদ্ধান্ত বলবত থেকেছে।”

অধ্যাপক নকীব লিখেছেন, “আমি খুব পরিষ্কার জানি, আমাদের সিদ্ধান্ত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশের পছন্দ হবে না, এটা স্বাভাবিক। দীর্ঘদিনের একটা সুবিধা উঠে গেলে ভালো লাগার কথা নয়। তবে তাদের শুভবুদ্ধির কাছে আবেদন, আপনারা ভাবলে বুঝতে পারবেন, দীর্ঘদিনের অপমান এবং অসম্মান থেকে আপনারা এবং আপনাদের সন্তানদের মুক্ত হওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

নিজের অবস্থান নিয়ে উপাচার্য লিখেছেন, “কোটার ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অবস্থান সবসময় পরিষ্কার। এই সব দাবি দাওয়া বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যখন কোনো নাম নিশানা ছিল না তখন থেকেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে কখনই আমি ব্যক্তিগত মনোভাবকে সামনে রাখিনি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার অনেক বড়। এদের সবার মতামতের মূল্য আছে। তবে সেই মতামত যৌক্তিক এবং ন্যায়সঙ্গত হতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে দুজন প্রোভিসির নেতৃত্বে একটা কমিটি গঠন করা হয়। উদ্দেশ্য- বিভিন্ন পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া। এই কমিটি ফর্মালি, ইনফর্মালি বহু চেষ্টা করেছে। তাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ঐক্যমতে পৌঁছানো যায়নি। আমি যথেষ্ট সময় দিয়েছি। আর সময় দেওয়ার সুযোগ নেই।”

উপাচার্য আরো লিখেছেন, “এই পুরো সময়টা আমার উপর যথেচ্ছ অপবাদ দেওয়া হয়েছে। আমি একেবারেই যা নই, তা বলা হয়েছে। শুধুমাত্র যারা মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত এবং ধানাই-পানাইয়ে অভ্যস্ত তারাই আমার কনভিকশন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের জন্য কোটা তুলে দেওয়া হয়েছে। কারণ এই কোটা রাখার পেছনে কোনো শক্তিশালী যুক্তি বা নৈতিক ভিত্তি নেই। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও মনে না করে, শুধুমাত্র দাবির মুখে এটা করেছি। ছাত্র-ছাত্রীদের কোন অন্যায় আবদার মানার কোনো দায় আমার নেই। এটা সামনে আরো পরিষ্কার হবে।

আগামীর কার্যক্রম নিয়ে তিনি লিখেছেন, “সামনের দিকে তাকাতে চাই। এই মুহূর্তে আমাদের ফোকাস চারটি। ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনমানের উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সামনের ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে নেওয়া এবং রাকসু নির্বাচন। এই সমস্ত কাজে মনোযোগ দিতে চাই। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। কোটা ইস্যু নিয়ে আর কোনো ধরনের যন্ত্রণা চাই না। নতুন যন্ত্রণা সৃষ্টির আর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এই ধরনের চেষ্টাকে অপচেষ্টা বলে বিবেচনা করা হবে।”

প্রশাসনকে আবারো আল্টিমেটাম
এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত না মেনে বুধবার (১ জানুয়ারি) রাত ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটে সংবাদ সম্মেলন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।

সেখানে রাবি সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার লিখিত বক্তব্যে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক সিলেকশন শুরু হতে যাচ্ছে আগামী ৫ জানুয়ারি। তাই আমরা ফাইনাল একটি সিদ্ধান্তে আসার জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) পর্যন্ত সাতদিনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। আমরা তাদের ১ শতাংশ কোটা রাখার সিদ্ধান্তকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি এবং আমরা আমাদের আল্টিমেটামের ওপরেই অনড় আছি।

তিনি বলেন, “প্রশাসনের কাছে এখনো ১৫ ঘণ্টা সময় আছে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার। আগামীকাল ২ জানুয়ারি সকাল ৯.৫০ মিনিটের আগে প্রশাসন পোষ্য কোটা বাতিলসহ তিনটি দাবি আদায়ে সহযোগিতা না করলে ৯.৫১ থেকে ১০টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হবে প্রশাসনিক ভবন ত্যাগ করার জন্য। তারপর অনিদিষ্টকালের জন্য প্রশাসনিক ভবনে ভালা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে সব শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ, আপনারা সব ক্লাস বন্ধ করে আগামীকাল সংস্কার কাজে অংশগ্রহণ করবেন।”

তিনি বক্তব্যে আরও বলেন, “আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিগত জুলাই বিপ্লবে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। যে বিপ্লবের মেইন মেন্ডেট ছিল, কোটার যৌক্তিক সংস্কার। কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী কোটার যৌক্তিক সংস্কার তো হয়নি, বরং একটি অযৌক্তিক, অবৈধ কোটা এখনো রেখে ২০২৪-২৫ সেশনের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিগত এক মাস ধরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে এবং প্রশাসনকে সময় দিয়েছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে আম্মার বলেন, “আমাদের আন্দোলনকে সাময়িকভাবে বন্ধ করার জন্য প্রশাসন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ আমাদের দাবি ছিল আজীবনের জন্য এই কোটা বাতিল করা। কিন্তু তারা তা করেনি।”

দাবি তিনটি হলো- পোষ্য কোটা আজীবনের জন্য বাতিল করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ে চিহ্নিত ফ্যাসিস্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রশাসন থেকে মামলা দিতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে; কেন চিহ্নিত দুই ফ্যাসিস্ট শিক্ষকদের সহকারী প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো, জনসম্মুখে এসে রেজিস্ট্রারকে তার ব্যাখ্যা দিতে হবে।

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/ফাহিম/মেহেদী


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়