ঢাকা     বুধবার   ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৪ ১৪৩১

কালজয়ী উপন্যাস সংশপ্তক: চূড়ান্ত বিজয় সত্যেরই

শহীদুল ইসলাম (শুভ) || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৭, ৬ জানুয়ারি ২০২৫  
কালজয়ী উপন্যাস সংশপ্তক: চূড়ান্ত বিজয় সত্যেরই

বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী মহাকাব্যিক অনবদ্য শৈল্পিক উপন্যাস হলো সংশপ্তক। ভাষা নৈপুণ্যে ও শিল্পকর্মে এক অনন্য জায়গায় স্থান করে নিয়েছে উপন্যাসটি। ঔপন্যাসিক শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১) তার এ উপন্যাসে তুলে এনেছেন সেকালের ইংরেজ শাসনের শেষ ও পাকিস্তানি আমলের শুরুর অবস্থা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে অবিভক্ত বাংলার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সমাজে চাটুকার চ্যালাদের কারণে সমাজ বাস্তবতাসহ নানা কুসংস্কার। 

সংশপ্তক বইটি পড়ে আমার কাছে যা মনে হয়েছে, তা হলো সাধারণ মানুষের মুক্তি। তাদের স্বাধীনতা; সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই। সরাসরি বইয়ের মধ্যে স্বাধীনতার কথা উল্লেখ না থাকলেও উপন্যাসটি সেটাই পাঠককে বুঝাতে সক্ষম। 

এর চিত্ররূপ এবং শৈল্পিক রূপায়ণ যেকোনো পাঠককে আকর্ষণ করবে। উপন্যাসের শুরুতে যেভাবে ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার লুকায়িত চিরাগত কুসংস্কার এবং সাধারণ মানুষের সহজ সরল জীবনের চিত্র ও গ্রামীণ বাংলার সৌন্দর্য, তা সত্যি প্রশংসনীয়। পূর্ব বাংলার একেবারে বাস্তবিক সমাজের বর্ণনা দিয়ে লেখক উপন্যাসের যাত্রা শুরু করেন।

সংশপ্তক একটি সামাজিক উপন্যাস হলেও এর একটি মাহাত্ম্য ও মতাদর্শ নিয়ে বিস্তৃত। পুরো উপন্যাসে সমাজে উঁচুনিচু ভেদাভেদ, যুদ্ধাহত পৃথিবীর ভয়ানক দৃশ্য এবং পরাধীনতায় গণমানুষের যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, তা তাদের বাঁচিয়ে রাখে একটি আশায়। হেরে যাবে জেনেও মানুষ লড়ে যায়, চালিয়ে যায় আন্দোলন। তেমনি একজন লড়াকু সৈনিকের নাম জাহেদ।

উপন্যাসের শুরু গ্রাম হলেও এর ব্যাপ্তি ঢাকা শহর থেকে কলকাতা ও রেঙ্গুন পর্যন্ত একাধিক জায়গায় বিস্তৃত।  জাহেদ শিক্ষিত, কলকাতা থেকে পড়াশোনা করে গ্রামে আসে মুক্তি নিয়ে। দেশ স্বাধীনতার মুক্তি নিয়ে গ্রামে গড়ে তুলে সংস্থা। আন্দোলনের পুরোধা নেতৃত্ব দেওয়া জাহেদ ভেবেছিলেন ইংরেজদের থেকে মুক্তি পেলে মানুষ মুক্তি পাবে। কিন্তু না, তার এই ধারণার ভুল প্রমাণ করে গ্রামের অল্প শিক্ষিত সেকান্দর মাস্টার। তিনি দেখতে পান, দেশ স্বাধীন হয়েছে, শোষক পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু শোষণ পরিবর্তন হয়নি। এখান থেকেই জাহেদের মতাদর্শ ও চিন্তার বাক-পরিবর্তন হয়। 

জাহেদের সঙ্গে আন্দোলন করলেও সেকান্দর মাস্টারের আদর্শ ছিল ভিন্ন। তিনি চেয়েছেন মানুষের মুক্তি, শোষণহীন, মানবতা ও সাম্যের সমাজ। এ নিয়ে জাহেদের সঙ্গে তর্ক হলেও অভিজ্ঞ সেকান্দর পিছুপা হয়নি। তিনি বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন তার আদর্শে। সমাজের হিংস্র দানবীয় পৈশাচিক জল্লাদদের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন। মানুষের অধিকার ও মুক্তির জন্য শেষ অব্দি তিনি থেকেছেন গ্রামে। তার অসীম সাহস উপন্যাসকে করেছে প্রাণবন্ত। 

সংশপ্তকের সমাজ বাস্তবতা ও রাষ্ট্রীয় ধরণ আজো বিদ্যমান। প্রাচীন প্রথা প্রচলিত সমাজে; নানা কুসংস্কার সেকালে ছিল, একালেও আছে। প্রাচীন বিশ্বাস ও মানসিকতা থেকে তারা বের হতে পারে না; পারে না নতুনত্বকে গ্রহণ করতে। নিজেদের পরিবর্তন করতে ও সংস্কারমুক্ত হতে পারছে না। আর যারা সংস্কারমুক্তের কথা বলেন, তাদেরও গ্রহণ করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় কিছু রক্ষকরা নিজের চরিতার্থের সুবিধার জন্য ভক্ষক হয়ে ভক্ষণ করছে গরিব অসহায় মানুষের রক্ত। এ যেন বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের চিত্র আজকের একবিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের বাস্তব চিত্র। 

সংশপ্তক পড়ে আমি আমার সমাজকেই দেখতে পেলাম। ফেলু মিঞাঁর মতো সমাজপতিরা সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করে। রমজানের মতো চাটুকার তাদের হাত-পা-কান -চোখ হয়ে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে যাওয়া কোনো গরিব কিংবা অসহায়দের কোনো খুঁত পেলে, তাদের বিরুদ্ধে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। হুরমতি তাদেরই একজন। সে ফেলু মিঞা ও রমজানের কামনার শিকার।

শুধু হুরমতি নয়, তার মতো রমজান ও ফেলুর শিকার লেকু, রাশু, সেকান্দর মাস্টার। তাদের অনেককেই করেছে গ্রাম ছাড়া। অনেককেই করেছে নিঃস্ব। তারা বলি হয় সেসব সমাজপতিদের তুচ্ছ ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ-লালসার। সেখানে সততার কোন মূল্য নেই। ক্ষোভে সেকান্দরের মতো অনেকেই বলেন, ‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি?’ জাহেদের রক্ত টগবগিয়ে উঠে। কিন্তু এর বেশি কিছু করার ক্ষমতাও তাদের নেই। 

রাবেয়ার মতো নারীদের অল্প বয়সেই অভিভাবকরা তুলে দিত তাদের পছন্দমতো পাত্রের হাতে। মেয়েদের কোন মতামত নেওয়ার প্রয়োজনবোধও মনে করত না। তাদের মতামতের কোন গুরুত্ব দেওয়া হতো না। ফলে বয়স্ক হলেও তাদের বিয়ে দিয়ে দিত। আজও রাবেয়ার মতো অনেক মেয়ের জীবন পাঁপড়ি ফোঁটার আগেই বিয়ে করতে হয়। রিহানার মতো নারীরা ভালোবাসার মোহে আবেগের বশে মালুর মতো সরল-সোজা মানুষকে রুক্ষ ও রূঢ় পাথর করে তোলে। কিন্তু মালুর আনন্দ, ‘এ পৃথিবীতে কোন মানুষকে সুখী দেখবার চেয়ে আর কোন বড় আনন্দ নেই।’ কিন্তু রিহানার মতো নারীর প্রেমে ও ভালোবাসার পরিবর্তনে তারা হয় শহর ছাড়া, গ্রাম ছাড়া এমনকি দেশান্তরী। 

উপন্যাসের একটি বড় প্লট হলো- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এসব দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নিরীহ সাধারণ মানুষ। কিন্তু এর ফল ভোগ করে রমজানের মতো রাজাকাররা এবং এলিট শ্রেণির লোক ও রাজনৈতিক দলের লোকজন। এসব দালাল রাজাকাররা যদিও কিছু সময়ের জন্য তাদের উত্থান হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সত্যেরই বিজয় হয়। চূড়ান্ত বিচারে বিজয় হয় জাহেদ সেকান্দরদের, তাদের আদর্শের।

এই মহাকাব্যিক উপন্যাসে ওঠে এসেছে সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি। সামজিক উপন্যাস হিসেবে এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হয়।

(লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)
 

ঢাকা/মেহেদী


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়