ঢাকা     বুধবার   ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৫ ১৪৩১

প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে

মো. লিখন ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৩০, ৭ জানুয়ারি ২০২৫  
প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে

ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করা, তাদের যৌক্তিক স্বার্থের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে জানানো এবং প্রয়োজনে চাপ প্রয়োগ করে নায্য অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দেওয়াকেই মোটা দাগে ছাত্র রাজনীতি বলে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা তোলা, এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করানো এবং সেই এজেন্ডার পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে পরিচালিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ছাত্র রাজনীতি বলা যায়।

এ সংজ্ঞাটি বৈশ্বিক। কিন্তু বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির সংজ্ঞা একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এখানে ছাত্র রাজনীতি ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণ নিয়ে কাজ করে না। দেশ স্বাধীনের পর থেকে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ক্ষমতাসীন দলগুলোর অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের খুঁটি হিসাবে ব্যবহার করে। দলীয় লেজুরবৃত্তির বাইরে গিয়ে মুক্ত চিন্তা, জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার্থীদের অধিকারের আদায়ের থেকে ভিন্নমত দমন, সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করাই যেন বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য।

বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতি মানেই আমাদের দৃশ্যপটে ভেসে উঠে সকাল-বিকেল নিয়ম করে হাতে তালি দিয়ে মিছিল ও জ্বালাময়ী কিছু স্লোগান, আধিপত্য বিস্তারে মারামারি, অস্ত্রের ঝনঝনানি, বাইক শোডাউন, হলে ডাইনিং ব্যবসা, সিট বাণিজ্য ও গেস্টরুমের নামে শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিল মিটিংয়ে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া।

এ দেশে ছাত্র রাজনীতি মানেই হচ্ছে লেজুরবৃত্তি, ছাত্রীদের মধ্যে চুলাচুলি, দিগম্বর করে অপমান করা, ন্যায্য প্রতিবাদের ভাষা রোধ করে দেওয়া, বোমাবাজি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, কথায় কথায় দলবদ্ধ হয়ে গাড়ি ভাংচুর করা, রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা মজবুত করা, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ, অকালে তরতাজা প্রাণ ঝরে যাওয়া, চর দখলের মতো হল দখলের মহড়া।
 
বাংলাদেশে যত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর প্রথম টার্গেট থাকে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়। সে জন্য বিরোধী দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোকে বের করে দেওয়া হয় এবং নির্যাতন করা হয়, যাতে তারা হল থেকে চলে যায়। এ নিয়ন্ত্রণের মূলে থাকে তাদের একছত্র আধিপত্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা।

এটি একটি বড় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, যার পেছনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিষয় থাকে। হল দখলের পর এসব সংগঠনের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা। যাদের জোর করে যেমন দলের কাজে লাগানো হয়, তেমনি দলের রাজনৈতিক কর্মী বানানোরও চেষ্টা করা হয়।

আবাসিক সংকট থাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোতে রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠনগুলোর বড় একটি অস্ত্র গণরুম। হলে একটি বৈধ ছিটের বিনিময়ে এখানকার প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের জুনিয়র শিক্ষার্থীদের না চাইলেও প্রতিটা রাজনৈতিক দলের মিছিলে যেতে হয়, তা সে ওই মতাদর্শে বিশ্বাসী হোক বা না হোক। যেতে হবেই; বাধ্য সে।

আমাদের মূল ধারার রাজনীতিই তো দুর্নীতি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত। যেখানে ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সেই দুর্নীতিবাজদের মাধ্যমেই, সেখানে ছাত্র রাজনীতি থেকে ভালো কিছু পাওয়ার আশা কীভাবে করা যায়! ছাত্রদের ব্যবহার করে জাতীয় রাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি আমাদের শিক্ষাঙ্গনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। এর থেকে পরিত্রাণ হওয়া উচিত ।

প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির লাগাম টেনে ধরার সময় এখনই। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির রয়েছে এক সোনালী অতীত। মাথা কেটে ফেলা যেমন মাথা ব্যাথার সমাধান নয়, ঠিক তেমন ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রিত ছাত্র রাজনীতির চর্চা করা কোন স্থায়ী সমাধান নয়। আর নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চার আঁতুড় ঘর হলো পরিবার ও প্রাথমিক শিক্ষা। সেখানে সুনজর দিয়ে জাতিগতভাবে আমরা যে সদাশয়, সদাচার এবং মানবিক সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে।

আধুনিকতা মানে গোঁড়ামি, ভণ্ডামি, নিজের ঐতিহ্যকে বিলিয়ে দেওয়া তা নয়। আধুনিকতা হলো মানসিক উদারতা। সব ভালো কাজের সঠিক মূল্যায়ন, চিন্তা ও মননে প্রগতিশীল আচরণ, অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা, অন্যের মতামতকে গুরত্ব দেওয়া। আর এগুলো অর্জন এবং সঠিক বাস্তবায়ন প্রতিফলিত হয় ছাত্র সমাজের মাধ্যমে। তাদের আচার-আচরণ, বিচরণে, কর্মে ও ব্যবহারে। এ গুণাবলী যতটা না সাধারণ জনতা চর্চা করবে, তার চেয়ে বেশি চর্চা করা প্রয়োজন রাজনীতির সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন বা হবেন, তাদের।

যেহেতু এ রাজনীতির অংশীদার হচ্ছে ছাত্র। কেন এ ছাত্ররা শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে কথা বলছে না? কেন তারা শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না? কেন ছাত্রনেতারা শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ ত্বরান্বিত করার কথা বলছে না? কেন শিক্ষার্থীদের হলে শিক্ষার সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলছেন না? কেন তারা শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির কথা বলছেন না?

এসব প্রশ্নের দ্বায়ভার যেমন ছাত্রনেতারা এড়িয়ে যেতে পারেন না, ঠিক একইভাবে তাদের অভিভাবকরাও পারেন না। এ সব জিজ্ঞাসার উত্তর যেদিন থেকে পাওয়া যাবে, সেদিন থেকেই ছাত্র রাজনীতি তার গৌরব ফিরে পাবে।

সৎ, দক্ষ নেতৃত্ব তৈরি করা ছাত্র রাজনীতির একটি মহৎ উদ্দেশ্য। আদর্শে চলমান, নীতি নৈতিকতায় শ্রেষ্ঠ নেতৃত্বরাই কেবল ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিলেই ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

(লেখক: শিক্ষার্থী, ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)

ঢাকা/মেহেদী


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়