অতিথি পাখির আগমনে মুখরিত ময়নাদ্বীপ, বিচরণ নিশ্চিতে জমির লিজ বাতিল
এস আহমেদ ফাহিম, নোবিপ্রবি || রাইজিংবিডি.কম
ময়নাদ্বীপের অতিথি পাখির ছবি তুলেছেন আশরাফুল ইসলাম শিমুল
শীতের আগমনে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) ময়নাদ্বীপ। শীতের ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে মিলে হাজারো অতিথি পাখির আগমন ময়নাদ্বীপের জলাভূমিকে পরিণত করেছে এক মায়াবী চিত্রে।
রাশিয়ার সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, হিমালয়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসহ বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে ছুটে আসে এসব অতিথি পাখি। এরা যেন শীতের দূত হয়ে ময়নাদ্বীপের জলাভূমি পরিণত হয়েছে এক সরগরম পাখির রাজ্যে, প্রকৃতিকে ভরিয়ে তুলছে এ নতুন উচ্ছ্বলতায়।
সারি সারি কুটকুটিয়া, সারস, বক, পানকৌড়ি, সাদা হাঁসসহ নানা জাতের পাখি নিজেদের উপস্থিতি দিয়ে ময়নাদ্বীপ রাঙিয়ে তুলেছে। তাদের ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলা, পানিতে ডুব-সাঁতার আর নিরন্তর কিচিরমিচির যেন এক অর্কেস্ট্রার সুরের মতো প্রকৃতিকে মোহনীয় করে তোলে।
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল থেকে শুরু করে গোধূলি— প্রতিটি মুহূর্তে ময়নাদ্বীপ যেন অতিথি পাখিদের মিলনমেলায় রূপ নেয়। প্রকৃতিপ্রেমী, ফটোগ্রাফার কিংবা নির্জনতাপ্রিয় মানুষ— সবার জন্যই ময়নাদ্বীপ একটি আবেগময় অভিজ্ঞতার নাম। ক্যামেরা হাতে পাখিদের উড়ন্ত মুহূর্ত কিংবা পানিতে খুনসুটি বন্দী করার জন্য আগত মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। প্রকৃতির মাঝে মিশে গিয়ে নিজেদের হারিয়ে ফেলা আর শীতের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে অতিথি পাখিদের সুরেলা ডাক শুনতে শুনতে সময় কাটানো যেন এক নীরব আনন্দ।
তবে ময়নাদ্বীপের সৌন্দর্য শুধুই চিত্তাকর্ষক নয়; এটি জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। শীতপ্রধান দেশ থেকে আগত এই পাখিরা ময়নাদ্বীপের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে। এদের উপস্থিতি শুধু প্রকৃতিকে রঙিন করে তোলেই থেমে থাকে না, বরং জলাভূমির জীবজগতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করে।
পাখিদের অভয়ারণ্য নিশ্চিত করতে এবং তাদের নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিমধ্যে ময়নাদ্বীপকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। দ্বীপ এলাকার জমিতে চাষাবাদ বন্ধ করতে সব লিজ বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ময়নাদ্বীপের বিভিন্ন স্থানে লাগানো হয়েছে বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড। যাতে লেখা রয়েছে ‘জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সময়ের দাবি’, ‘ময়না দ্বীপ এলাকায় চাষাবাদ নিষিদ্ধ’, ‘পাখিরা ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকব’।
এ ছাড়া ময়না দ্বীপ এলাকায় শব্দদূষণ, গানবাজনা, পিকনিক, উচ্চস্বরে কথা বলা, পাখিদের ভয় দেখানো ও ঢিল ছোড়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ময়নাদ্বীপ এলাকায় প্লাস্টিক, পলিথিন ও খাবারের প্যাকেট ফেলাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসটিই বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফ আল জাওয়াদ বলেন, “আমাদের ক্যাম্পাসের সব থেকে সুন্দর দিক হলো শীতকালে অতিথি পাখির আগমন। এ অতিথি পাখিকে উপলক্ষে ক্যাম্পাসে দর্শনার্থীর সংখ্যা আগের থেকে বেড়ে গেছে। নোয়াখালী ও তার আশপাশের মানুষেরা অতিথি পাখি দেখতে আসেন। এতে আমাদেরও ভালো লাগে। আমাদের উচিত এ সৌন্দর্য ধরে রাখা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনেরও উচিত, অতিথি পাখি সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান বলেন, “আমার কাছে নোবিপ্রবির সৌন্দর্য মানে তিনটি জিনিস। শরতের কাশফুল, শীতের অতিথি পাখি আর সূর্যমুখী ফুল। অতিথি পাখি নোবিপ্রবির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সারাদিনের ক্লাস শেষে মনোসরণি কিংবা শান্তি নিকেতনের টঙে বসি। ওই সময় অতিথি পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শুনে মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়। ময়না দ্বীপজুড়েই তাদের রাজত্ব। চারদিকে ফুটে থাকা নানা রঙের ফুলের ভিড়ে এসব পাখি যেন ক্যাম্পাসের ১০১ একরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।”
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাহিদ সুলতানা বলেন, “আমরা পুরো ক্যাম্পাসকে সবুজ ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি জায়গাকে পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছি। সেগুলো হলো ময়নাদ্বীপ, গেস্টহাউজ সংলগ্ন এলাকা এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল সংলগ্ন জলাভূমি। এসব স্থানে পাখিদের নিরাপদ বিচরণে যাতে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারেন কিংবা কারও কোনো কর্মকাণ্ড পাখিদের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখছি।”
নোবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইসমাইল বলেন, “বিগত বছরে ময়নাদ্বীপে ধানের চাষাবাদ হতো। এ বছর ধানের লিজ বাতিল করে শীতকালীন অতিথি পাখির অভয়ারণ্য ও আবাসস্থল রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে আরো সুন্দর করার জন্য আমরা শুধু ময়নাদ্বীপ ছাড়াও আরো দুটি স্থানে শীতকালীন পাখি ও দেশীয় পাখির অভয়ারণ্য করতে চাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “আমরা নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও মেঘনা অববাহিকায় শীতকালীন পাখির আবাসস্থল করার জন্য ইতোমধ্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছি। এর মধ্য দিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে শীতকালীন পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে পারব। এর মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেমন গবেষণা কার্যক্রমে নিযুক্ত হতে পারবে, তেমনি পরিবেশের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও পর্যটনের বড় সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ঢাকা/মেহেদী