ঢাকা     শুক্রবার   ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৬ ১৪৩১

ত্রিশ নাকি তিন: বিতর্ক ও বাস্তবতা

রবিউল আওয়াল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ৯ জানুয়ারি ২০২৫  
ত্রিশ নাকি তিন: বিতর্ক ও বাস্তবতা

মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা ৩ লাখ নাকি ৩০ লাখ, এ নিয়ে বিতর্ক বহু পুরনো না হলেও নেহাত নতুন নয়। এ বিতর্কে ঘি ঢেলেছে মেজর ডালিমের ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ৩ লাখ’ মন্তব্যে।

মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ নয় ৩ লাখ; শেখ মুজিব সাংবাদিক ডেভিড ফস্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৩ লাখ আর ৩ মিলিয়ন সংখ্যাটা গুলিয়ে ফেলেছিলেন- এ তত্ত্বের প্রবক্তা বিবিসি বাংলার সাবেক উপপ্রধান সিরাজুর রহমান।

তিনি দ্য গার্ডিয়ান থেকে প্রকাশিত এক লেখায় বলেন, “আমি তাকে (শেখ মুজিবুর রহমান) বলেছিলাম, হতাহতদের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের অনুমান হলো এই যুদ্ধে ৩ লাখ লোক মারা গেছে। আমি অবাক হলাম যখন তিনি ডেভিড ফ্রস্টকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেন, ‘আমার ৩ মিলিয়ন মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে।’ তিনি কি ‘লাখ’কে ‘মিলিয়ন’ হিসেবে ভুল অনুবাদ করেছিলেন, নাকি তার বিভ্রান্তিকর অবস্থা এর জন্য দায়ী ছিল, আমি জানি না। তবে অনেক বাংলাদেশি এখনও বিশ্বাস করেন যে, ৩ মিলিয়নের সংখ্যাটা অবাস্তব ও অবিশ্বাস্য।"

মেজর ডালিম নিজেও সিরাজুল রহমানকে উদ্ধৃত তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এদিকে, ব্রিগেডিয়ার আযমীও সম্প্রতি বলেছেন, ‘শেখ মুজিব ৩ লাখ শহীদকে ৩০ লাখ ঘোষণা করেছিলেন।’

এখন বিচার্যের বিষয় হলো- ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটা কি শুধুই শেখ মুজিবুর রহমানের মস্তিষ্ক প্রসূত কথা নাকি তার আগেও এ সংখ্যার অস্তিত্ব ছিল। যদি এ সংখ্যাটা শেখ মুজিবুর রহমানের বলার পূর্বে উল্লিখিত হয়ে থাকে, তাহলে এটা মুজিবুর রহমানের ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া অন্যায় হবে। 

সর্বপ্রথম ৩০ লাখ মানুষ হত্যার কথা বলেন খোদ ইয়াহিয়া খান। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এক সভায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলেছিলেন, “ওদের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা কর, বাকিরা আমাদের পা চাটবে!”

তবে এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো- মুক্তিযুদ্ধে ৩ লাখ শহীদ হয়েছে বলে বয়ান প্রতিষ্ঠা করার যে প্রয়াস বা অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে, সেটা তৎকালীন প্রকাশিত পত্র-পত্রিকাগুলো সমর্থন করে না। ১৯৭১ সালের এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই, আগষ্ট মাসের দিকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলো শহীদের সংখ্যা উল্লেখ করেছে- ৫, ৭, ১০ লাখ। সেখানে সিরাজুর রহমান, মেজর ডালিম, ব্রিগেডিয়ার আযমীসহ অন্যান্যরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের মোট শহীদের সংখ্যা ৩ লাখ। 

এবার আলোকপাত করা যাক, ৯ মাস যুদ্ধের পরে মোট শহীদের সংখ্যা উপর।

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর চরমপত্র অনুষ্ঠানের শেষ প্রচারে এমআর আখতার মুকুল বলেন, “...২৫ মার্চ তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালিগো বেশুমার মার্ডার করনের অর্ডার দিয়া কি চোটপাট! জেনারেল টিক্কা খান সেই অর্ডার পাইয়া ‘৩০ লাখ’ বাঙ্গালির খুন দিয়া গোসল করল। তারপর বঙ্গাল মুলুকের খাল-খন্দক, দরিয়া-পাহাড়, গেরাম-বন্দরের মইদ্দে তৈরি হইল বিচ্ছু। যেই রকম বুনোওল সেইরকম বাঘা তেঁতুল।” (চরমপত্র, পৃ: ৩২৫)

এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্র অনুষ্ঠান‌ নিয়ে আহমেদ ছফার একটা মূল্যায়ন জুড়ে দেওয়া প্রয়োজন বোধ করছি।

তিনি বলেছেন, “এমআর আখতার মুকুল ট্যাঙ্ক ধ্বংস করছেন, গানবোট ডোবাচ্ছেন, সৈন্যভর্তি ট্রেনসহ ব্রিজ উড়িয়ে দিচ্ছেন, সেনা ছাউনিতে ছাউনিতে ত্রাসের সঞ্চার করছেন। এ পর্যন্ত তিনি যত পাকিস্তানি সৈন্য খুন করেছেন, যত জখম করেছেন, যত ট্যাঙ্ক অচল করেছেন, যত কনভয় ধ্বংস করেছেন, সব মিলিয়ে যোগ করলে যে সংখ্যাটা দাঁড়াবে, তাতে করে একজনও পাকিস্তানি সৈন্য বাংলার মাটিতে থাকার কথা নয়। …….. আমরা জানতাম, এম. আর, আখতার সাহেব যা বলছেন, তার দু’শতাংশও যদি সত্য হত, তাহলেও আমাদের যুদ্ধের পরিস্থিতি এ রকম হওয়ার কথা নয়। সব মিথ্যে জেনেও আমরা পরের দিনের চরমপত্র পাঠ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।” (উপন্যাস: অলাতচক্র)

আমার মনে হয়েছে ইতিহাসকে নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করার জন্য এ অংশটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এমআর আখতার মুকুল মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য অতিরঞ্জিত কথা বলতেন এবং ছফা নিজেও এতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, তা তিনি একই উপন্যাসে অকপটে স্বীকার করেছেন।

কিন্তু যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে এমআর আখতার মুকুল শহীদের সংখ্যা বাড়িয়ে বলেছেন কি-না বা বলার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি-না সেই বিচারের ভার এখন পাঠকদের উপর বর্তায়। 

মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা বিষয়ক বইয়ের লেখক আরিফ রহমান তার এক প্রবন্ধে তৎকালীন শহীদের সংখ্যা নিয়ে যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল, আমি তার কোন পরিবর্তন না করে হুবহু উদ্ধৃত করছি- 

“বঙ্গবন্ধুই যদি ভুলটি করে থাকেন তাহলে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ পর্যন্ত নিচের সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে ত্রিশ লাখ শহীদের কথা কী করে এল। যেমন দৈনিক পূর্বদেশ-এর সম্পাদক তার পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘ইয়াহইয়া জান্তার ফাঁসি দাও’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে পরিষ্কার লেখা হয়, ‘হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দু’শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে...।’ এরপর রাশিয়ার প্রাভদা, ৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ ত্রিশ লাখের কথা উল্লেখ করে। মর্নিং নিউজ, ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ ত্রিশ লাখের কথাই আবার উল্লেখ করে সেই সংখ্যাটা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়। ঢাকার পত্রিকা দৈনিক অবজারভার শিরোনাম করে এভাবে, ‘পাক আর্মি কিল্ড ওভার ৩০ লাখ পিউপল’, যেটা প্রকাশিত হয় ০৫.০১.১৯৭২ তারিখে মুজিব দেশে আসার ৩ দিন আগে। ৪ জানুয়ারি আজাদ পত্রিকাও প্রাভদার কথা উল্লেখ করে তাদের সংবাদে। দৈনিক বাংলা পত্রিকা তাদের ৬ জানুয়ারি, ১৯৭২ ‘জল্লাদের বিচার করতে হবে’ শিরোনামে করা প্রবন্ধ ত্রিশ লাখ শহীদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। যেটা প্রকাশিত হয় ৮ তারিখের আগে।”

স্বয়ং মওলানা ভাসানীও যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১০ লাখ শহীদের কথা উল্লেখ করেছেন। কবি আসাদ চৌধুরী তার ‘বারবারা বিডলার-কে’ নামক কবিতায় ১৫ লাখ হত্যার কথা বলেন, যেখানে তিনি ইয়াহিয়ার নৃশংসতাকে মধ্যযুগীয় নৃশংসতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি লিখেছেন-

“আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা।
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁ’র ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লাখ নিরস্ত্র লোককে সে গলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে-হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।”

ইতিহাস একজনের কথার উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় না। মেজর ডালিম একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তৎকালীন সময়ে ময়দানে যুদ্ধ করেছেন। সারাদেশে কত সংখ্যক মানুষ মারা গেছে সেটা জানার জন্য তাকেও অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। কাজেই তার কথাকে বেদবাক্য হিসেবে গ্রহণ করার কোন যৌক্তিকতা নেই।

অপরদিকে, শেখ মুজিবুর রহমান যেহেতু কারাগারে ছিলেন, তাকেও পুরোপুরি অন্যের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করতে হয়েছে। কাজেই তার বলা কথাকে বাইবেল মনে করা যাবে না। এ বিষয়ে প্রয়োজন ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য, উপাত্ত ও গবেষণার ফলাফল ৩০ লাখ সংখ্যাটাকে অধিক সমর্থন করে। 

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ডি ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী মোহাম্মদ ইরফানের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, “সংবাদ বিশ্লেষণ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদন ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে ৩০ লাখের যে সংখ্যা মুক্তিযুদ্ধের দেশজ বয়ানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই কেবল আরও গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব। .......একাত্তরের গণহত্যাকে বিশ্বের অন্যতম উচ্চমাত্রার গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত করতে হলে আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে প্রকাশের যোগ্য উচ্চমানের গবেষণায় হাত দিতে হবে আমাদের নিজেদের গবেষকদের।”

আর যারা দেশজ বয়ানের বিরোধীতা করছেন তাদের শুধু মুখে বললে হবে না, কাউন্টার নারেটিভ প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক বৈজ্ঞানিক গবেষণা। তবে সকল প্রচেষ্টা হওয়া চায়- সত্যের সন্ধানে। কারো সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ কিংবা সংশয় থাকলে, ইতিহাসের নির্মোহ পর্যালোচনা হোক, গবেষণা হোক। কিন্তু সংখ্যা নিয়ে নোংরা রাজনীতি আমাদের শহীদদের হীন করে, নিচ করে। কাজেই এটা যেকোন অবস্থায় সম্পূর্ণভাবে ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য। 

মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ৩ লাখ এ নারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার পেছনে অনেকের দুরভিসন্ধি রয়েছে। শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ না হয়ে ৩ লাখ বলার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য পাকিস্তানের বর্বরতা, নির্যাতন, পশুত্বমূলক আচরণকে লঘু করা; সংখ্যাটা যা-ই হোক। পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। যারা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, তাদের ঋণ কখনো শোধ হবার নয়। আমরা তাদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি, তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।

(লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)

ঢাকা/মেহেদী


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়